Skip to main content

এভাবেই থেকো

হাতের মুঠোফোনে বিশ্বসংসার দেখে আজকাল বেশ সময় কেটে যায় উৎপলবাবুর। ফেসবুকের অনেকগুলো গ্ৰুপেরৈ চোখ রাখা আর কমেন্টে থাকা এইসব নিয়ে সময়ই পান না তেমন। কোন রকমে সারেন নিজের প্রাত‍্যহিক কাজকর্ম তারপরেই আবার ফোনপুজো শুরু হয়। তাছাড়া প্রায়ই এই গ্ৰুপ অথবা অন‍্য কোন গ্ৰুপের মিট হয়,সেখানেও সবাই উৎপলদা করে ব‍্যস্ত। এই বয়েসেও নিজের পপুলারিটি বেশ উপভোগ করেন।
  সুযোগ পেলেই চলে যান গ্ৰুপ মিটে,আর উনিও মিস করতে চান না সেই সব আড্ডা আর হাসি মজার সুযোগটুকু। দমবন্ধ করা জীবনে তো এখন ফেসবুকই খোলা জানলা আর ঐ মিটিং গুলো খোলা সবুজ বাগানের মত। ইচ্ছে মত ঘুরে,হাসি,মজা আর খাওয়াদাওয়া করে অনেকটা অক্সিজেন নিয়ে ফিরে আসা।

    সেই সুবাদে বন্ধুর তালিকাও বেশ ভারী হয়েছে,তবে আজকাল যাকে তাকে নেন না বন্ধুত্ব তালিকায় উৎপলবাবু। রীতিমত খানা তল্লাশী করে ঢোকান তার ফেসবুকগৃহে। আর যাদের প্রোফাইলে তালা তাদের ঢোকার মুখে তিনিও তার ফেসবুক গৃহে তালা লাগিয়ে দেন।
        কদিন ধরেই 'হঠাৎই বন্ধু হওয়া' গ্ৰুপটাতে সমানে পোস্ট হচ্ছে গ্ৰুপ মিটের জন‍্য। এই সুযোগগুলো মিস্ করেন না উৎপলবাবু। তার স‍্যাতসেতে জীবনে এইগুলোই তো কাঠফাটা রোদের তাত,তাতে নিজে বেশ কিছুটা ওম নিয়ে গরম হয়ে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দেন।
    এবার একটাই ঝামেলা এরা সব সস্ত্রীক আসার জন‍্য বায়না করেছে। গ্ৰুপের অ্যাডমিন জানিয়েছেন যারা বিবাহিত পুরুষ তারা বৌ সহ এবং বিবাহিত মহিলারা বর সহ আসবে।
    অনেকেই প্রশ্ন রেখেছে আর যাদের বৌ বা বর নেই তারা কী করবে? অ্যাডমিন মুচকি হেসে বলেছে সেক্ষেত্রে ব‍্যাচেলার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। এই নিয়েও বিস্তর মজা হচ্ছে।
      মহা ঝামেলার ব‍্যাপারটা,অথচ অনেকেই সাধু সাধু করেছেন প্রস্তাবে। উৎপলবাবুর মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায় যখনি মনে পড়ে ললিতাকে নিয়ে যেতে হবে গ্ৰুপ মিটে।
     ফুরফুরে উৎপলবাবুর পাশে একসময় যৌবনে যে ললিতা একদম লবঙ্গ লতিকা ছিল সে এখন মোটামুটি বাইরে বেরোনোর অচল।
       একমাত্র মেয়েকে বেশ কম বয়েসেই বিয়ে দিয়েছেন। আর এখন ললিতার জীবন আলস‍্যের ব‍্যাধিতে বিষময়। ব‍্যথায় বিষে আক্রান্ত জীবনে একমাত্র কাজ হয়েছে শুয়ে শুয়ে মেয়ের কাছে শরীর খারাপের কাঁদুনি গাওয়া।
     আজকাল আর ভালো লাগে না উৎপলবাবুর এইসব। অবশ‍্য বাড়ির মেয়েমানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তিনি আগেও তিনি মেজাজ হারাতেন। খেটেখুটে আসব বাড়িতে আর রোগের ঘ‍্যানর ঘ‍্যানর।
    একটা সময় মেয়ের কচকচানিতে ডাক্তার বদ‍্যি দেখিয়েছেন,পরে শুনেছেন এ রোগ পুরোপুরি সারবে না কোনদিনই। কখনও একটু কমলেও এই ব‍্যথা বেদনা নিয়েই চলতে হবে। 
       এখন আর পাত্তা দেন না তেমন করে। দেখেছেন পাত্তা দিলেই এরা মাথায় চড়ে বসে। তাই উঃ আঃ করছে করুক। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না দেখলেই চুপ করে যাবে।
    নিজের জগতে তিনি বেশ আছেন, বরং এই ফেসবুকের ঘরে এসে তিনি অসীম আনন্দ পান। তারপর সকালে বিকেলে বন্ধুদের দলে আড্ডা মেরে অনেকটা অক্সিজেন নিয়ে ফেরেন।
           বাকি সময়টা চলে ফেসবুকের আড্ডা,তাতে টুংটাং শব্দ হলেই মনে দোলা দেয়। এই বুঝি কেউ মেসেজ করলো।
          এই গ্ৰুপে কিছু সুন্দরী মেয়ে তাকে দাদা দাদা করে ডেকে অস্থির করে। একজন তো একটা শ্রুতিনাটক রেকর্ড করল তার সাথে। গলাটা বেশ ভালো এখনও উৎপল বাবুর। অনেকেই খুব প্রশংসা করেছে নাটকটার।
        তাই যাওয়াটা জরুরী এই গ্ৰুপ মিটে,তাছাড়া তার ওপর অনেক দায়িত্ব। গজগজ করতে করতেই কথাটা ললিতাকে বলেন। ' যত এদের হুজুক,উঠলো বাই তো কটক যাই। আমার সমস‍্যাটা কাকে বোঝাবো? এই জগদ্দল পাথর নিয়ে যাওয়া।'
কথাগুলো ললিতার কানে গেলেও বাইরে যেতে পারবেন এই শুনে ললিতার মুখটা হঠাৎই চকচক করে ওঠে। এমন কথা তো দিনরাত কতই শুনছেন,প্রথমটা চোখ ছলছলিয়ে জল বইত এখন অভ‍্যেস হয়ে গেছে অপমানিত হতে হতে। নিজেকে একটা বোঝা বলেই ভাবার অভ‍্যেস হয়ে গেছে।
      তাই যাবার কথা শুনে একবারও বলেন না যাব না। কতদিন বাইরে যাওয়া হয়নি তার। ওর ব‍্যথার অজুহাতে লোকটা তো কোথাও যাওয়ার কথাই উল্লেখ করে না ভুলেও। ও যেতে চাইলেও দাবড়ানি দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়..' তুমি হাঁটতে পারবে? তারপর একদিন ঘুরে এসে দশদিন ব‍্যথায় কোঁ কোঁ করবে। চুপ করে যেতে হয়েছে ললিতাকে। তবে এবার ব‍্যাপারটা একটু অন‍্যরকম তাই হয়ত যাওয়া হবে একটু খোলা হাওয়ায়। আহা একটা সময়ে এই পিকনিকে যেতে কি ভালো লাগত তার। সবাই মিলে সেজেগুজে যাওয়া সারাদিন খাওয়া দাওয়া আর শীতের রোদ পিঠে দিয়ে আড্ডা দিয়ে গল্প করে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরা। এখন সেসব এখন অতীত।
           মেয়ের কাছেও দরবার করেন উৎপলবাবু তবে মেয়েও শুনে বলে নিয়ে যাও মাকে। বাইরে গেলে লোকজনের মাঝে মনটা ভালো হবে। একা বসে বসে বাড়িতে আরও রোগ বাড়ছে।
      'তুই তো বলেই খালাস, নিয়ে যাওয়ার তো ঝক্কি কম নয়,গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যেতে হবে। তারপর গিয়ে তো সেই এক জায়গায় বসবে আর নড়বে না।'
 বৌ দেখবেন না অন‍্য কাজ করবেন। সত্যিই অসহ‍্য লাগে। একবার অ্যাডমিনকে বলেছিলেন বৌয়ের অসুস্থতার কথা সে তো হইহই করে সব চাপা দিয়ে দিল। অগত‍্যা বৌকে নিয়েই বেরোতে হবে আর কিছু করার নেই।

     ললিতা শাড়ি প‍রতে চাইলেও বরের বকুনি খেয়ে আর সাহস পেল না। ধমকে ওঠেন উৎপলবাবু,' একেই খোঁড়া তারপর আবার ঘোড়াতে ওঠার শখ। কোথায় হোঁচট খেয়ে পড়বে তার ঠিক নেই।
      কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘষটে ঘষটে টেনে নিয়ে রেডি হন ললিতা। কতদিন বাদে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন যেন,নিজের কালিপড়া চোখ আর পাকা চুলের রাশি মনটাকে ভারাক্রান্ত করে।
তোলে। গায়ের রঙটাও অদ্ভুত চেপে গেছে এখন।
    যে চোখ একটা সময় পাগল করেছিল উৎপলবাবুকে আজকাল সেই চোখের দিকে তাকানোরও সময় নেই তার। আর কখনও তাকালেও ঝরে পড়ে সেই চোখে অবজ্ঞা আর একরাশ বিরক্তি। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে কাঁদেন ললিতা। এই অবহেলা যেন কাঁটার মত বেঁধে তাকে।
                সত‍্যিই কী দেহের টান চলে গেলে সবই চলে যায়? নাকি মানুষটা কখনই ভালোবাসেননি তাকে? পাশাপাশি থাকাই বোধহয় সব নয় যদি সহানুভূতি নিয়ে পাশে না থাকা যায়। আজকাল মনে হয় কোথায় কত দূরে বাস করেন ওরা দুজন। বয়েসের সাথে সাথে মনের দূরত্ব বেড়েছে অনেকটা।

   যত ললিতার নির্ভরতা বেড়েছে উৎপলবাবুর ওপর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন‍্য ততই উনি সরে যেতে চেয়েছেন ললিতার পাশ থেকে। বয়েসের ভার বোধহয় মানুষকে কিছুটা স্বার্থপর করে তোলে,তাই যেখানে স্বার্থ নেই সেখান থেকে মানুষ দূরে সরে যায়।

       আর যে ললিতা একটা সময় দুইহাতে দশহাতের কাজ করেছেন আজ তিনি সংসারে অকেজো। অবশ‍্য তার জন‍্য ললিতার অনেক দায় রয়েছে। ডাক্তার অনেক সাবধান করা সত্ত্বেও যতদিন পেরেছেন নিজের গুরুত্ব সংসারে জাহির করতে আর সবাইকে খুশি করতে আপ্রাণ কাজ করে গেছেন।   
          আনমনা ললিতা হঠাৎই চমকে ওঠেন উৎপলবাবুর বাজখাই গলার ধমকে।
  ' তোমার এখনও হয়নি? উহ্ এদের বায়না রাখতে কী যে ঝামেলায় পড়েছি আমি! দেরী হয়ে যাচ্ছে তো,আমার অনেক দায়িত্ব ওখানে।'
     উৎপলবাবুর এই গলা বন্ধুমহলে পপুলার হলেও ঠান্ডা মেজাজের ললিতা বরাবরই এই গলাকে ভয় পেয়ে এসেছেন। একটা সময় কখনও বা বলতেন,' খামোখা চেঁচিয়ো না,তুমি জোরে কথা বললে আমার সব কাজকর্ম গুলিয়ে যায় টেনশনে। আমাকে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে দাও।'
         ' হ‍্যাঁ ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে গিয়ে আঠারো মাসে বছর কাটাও। তোমার জন‍্য আমার ট্রেন ফেল হয়ে যাবে।'
   ললিতা খাবার নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বলতেন,'কবে তুমি ট্রেন মিস্ করেছো বলতো এই এত বছরে?'
        আজ কোন কথা বলেন না ললিতা,শুধু বলেন.. 'এই তো হয়ে গেছে।'
    উৎপলবাবুর চেহারাপত্র ভালো, নিয়মিত শরীর চর্চা আর হাঁটাহাঁটি করেন। ললিতার মত জগদ্দল পাথর নন তিনি। আজ লাল টি শার্ট আর জিন্সের প‍্যান্ট আর ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে তাকে বেশ স্মার্ট লাগছে।

        ললিতার আজকাল সিঁড়ি দিয়ে নামতেও প্রচন্ড কষ্ট হয়,আর্থারাইটিস তাকে মোটামুটি পঙ্গু করে দিয়েছে। উৎপলবাবুর হাতটা ধরার জন‍্য হাত বাড়ান ললিতা। বিরক্ত হয়ে তাকান উৎপলবাবু,অসহ‍্য হয়ে গেছে জীবন আমার মনে মনে বলেন,ললিতা কর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বোঝেন। কিন্তু অপরাধীর মত চুপ করে থাকেন।

    বেশ কষ্ট করে গাড়িতে উঠে পৌঁছোন বেশ ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে গন্তব‍্যে। বারবারই ঘড়ি দেখছেন উৎপলবাবু,তার মাঝে বেশ কয়েকটা ফোন এল।
   যে মানুষটা এতক্ষণ ঘরে রুক্ষতায় ফেটে পড়ছিলেন ফোনে তার গলাতেই মাখনের প্রলেপ। গলাকে মোলায়েম করে বলেন,'আরে সাধে কী বলা পথে নারী বিবর্জিতা..এই এসে পড়ছি। আর কিছুক্ষণ লাগবে।
   হ‍্যাঁ বীথি তোমার স্ক্রিপ্টটা পড়বে তো আজ? আমাদের একটা একসাথে পাঠও তো আছে। ব্রেকফাস্ট এসে গেছে? আমাদের অ্যাডমিন সাহেব কোথায়? ও এখনও আসেননি। আচ্ছা আচ্ছা আমিও একটু বাদেই পৌঁছে যাবো।'
         একটা বাগানবাড়ি মত জায়গাতে গেটটুগেদারের ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হাঁটা,উৎপলবাবু নেমেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চান সামনের দিকে। 
    ললিতা পেছন থেকে ডাকে,'এই যেয়ো না। আমার হাতটা একটু ধরো। ভেতরে তো অনেকটা যেতে হবে।'
    'তোমাকে কতবার বলেছি একটা লাঠি নাও এবার,মেয়েও তো বললো অসুবিধা হলে নাও। তা তুমি তো শুনবে না। আর কী.. করে যাও যত পারো আমার ওপর।'
    ললিতার গলাটা বুজে আসে উৎপলবাবুর খোঁচা মারা কথায়। তবুও চুপ করে যান কিছু বলেন না। আসলে এই অবস্থার জন‍্য অনেক দোষ তার নিজের।
     সবার কাছে ভালো হতে গিয়ে একটা সময় অক্লান্ত পরিশ্রম আর অযত্নের ফল ভোগ করছেন। এখন ধরেছে ক্লান্তি আর না ভালো লাগা,কিছু করতে ইচ্ছে করে না কেন যেন। একটা অদ্ভুত একাকীত্ব গ্ৰাস করছে দিন দিন। হয়ত উৎপলবাবুর একটু সহানুভূতি আর ভালোবাসা মুছিয়ে দিতে পারত অনেক কিছুই। কিন্তু সেই মানুষটাও কেমন যেন হয়ে গেছে,অদ্ভুতভাবে নিজে ডুবে গেছে নিজেকে খুশি রাখার জগতে।
   আসলে একটা সময় বোধহয় কেউই পাশে থাকে না,নিজেকেই নিজের পাশে থাকতে হয়। আর সেই নিজেকেই আমরা কতশত অজুহাতে অবহেলা করে চলি প্রতিনিয়ত।

     তবে ললিতার বোঝা আর বেশিক্ষণ বইতে হয় না ক্ষুব্ধ উৎপলবাবুকে। গ্ৰুপের দুএকটা ছেলেমেয়ে ছুটে আসে ওদের দেখে যদিও ললিতা ওদের চেনে না তবুও ওদের এইটুকু সহযোগিতা ওকে ছুঁয়ে যায়।
  -'আসুন আসুন বৌদি আমার হাতটা ধরুন। যাক ভাগ‍্যিস প্রণবদা এবার সবাইকে গিন্নী সহ আসতে বলেছেন তাই আপনার দেখা পেলাম।'
   একজন বলল,' আপনার হাঁটতে কী খুব কষ্ট? আমার মায়েরও এমন হত এখন হোমিওপ্যাথি করে ভালো আছে। আমি নাম্বারটা দিয়ে দেব উৎপলদাকে।'
      ওরাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ললিতাকে পৌঁছে দেয় জায়গা মত। একটা প্লাস্টিক চেয়ারে বসতে কষ্ট হয় ললিতার তাই তাড়াতাড়ি করে ওরা দুটো চেয়ারকে একসাথে করে দেয়। 
     ললিতার মনটা ভিজে যায়,ওর চোখদুটো তখন উৎপলবাবুকে খুঁজছে। অনেকটা দূরে ওর জীবনসঙ্গীকে দেখতে পায়,অনেকের মাঝে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন আর গল্প করছে।
      অভিমান হয় ললিতার এই মানুষটার হাত ধরেই তো এসেছেন এখানে। সে দিব‍্যি ওকে ছেড়ে ওখানে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। এক কাপ চা তো দিতে পারত এগিয়ে।
      একটা কমবয়েসী মেয়ে ললিতার অভিমানের মেঘ সরিয়ে দেয় হঠাৎই। 'ও বৌদি অনেকটা এসেছেন,একটু চা খেয়ে রেস্ট নিন। এই বৌদিকে  বিস্কুট দাওনা। আপনি চা খান একটু বাদেই ব্রেকফাস্ট হবে আমি দিয়ে যাবো তখন।'
   ললিতার লজ্জা লাগে,কাচুমাচু মুখে বলে,' না না আমি ওখানে গিয়ে খেতে পারব। এখানে কষ্ট করে আনতে হবে না।'
      'আচ্ছা বেশ আমি এসে এদিকে আপনাকে নিয়ে যাবো। দাদা তো ওদিকে ব‍্যস্ত,অনেক কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন তো।
    দাদা কিন্তু দারুণ মানুষ,আমাদের গ্ৰুপে তো সবাই চেনে দাদাকে। নিজেও গুণী মানুষ আবার অন‍্যদেরও গুণের কদর করেন। আমরা তো যা দু চারলাইন লিখি সব লেখাতেই দাদা কমেন্ট করেন।'
            মেয়েটার কথা শুনতে শুনতেই আনমনা হয়ে যান ললিতা যিনি মোটামুটি সারাজীবন শুনে এসেছেন সংসার করো গুছিয়ে। সেটাই তোমার জায়গা,তোমার অন‍্য গুণ আমার দেখার দরকার নেই। অমন একটা দুটো গান আর কবিতা বিয়ের বাজারে কদর পেতে অনেকেই শেখে।
        মেয়েটার সাহায‍্যেই খাবার টেবিলে যান ললিতা,উৎপলবাবু একটু বিরক্তই হন। বলেন,' তুমি আবার এখানে এলে কেন? কোথায় পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই।'
    কমবয়েসী মেয়েটার নাম কাকলি সে উত্তর দেয়,'আমিও বলেছিলাম সেটাই বৌদি বললেন পারবেন।'
   কথা আর এগোয়না,সামনে এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান। উৎপলবাবুর মুড বদলে যায়..'আরে স্বয়ং অ্যাডমিন এত দেরি করে এলে হয় নাকি? আমি কোন ভদ্রেশ্বর থেকে চলে এসেছি সেই সাতসকালে। গিন্নী কোথায়?
    আমরা কিন্তু আজ্ঞাবহ হয়ে অনেক হ‍্যাপা করে নিয়ে এসেছি। এই তো দেখছেন মিসেসের শরীরের কী অবস্থা!'
       অ্যাডমিন ভদ্রলোক ললিতাকে হাতজোড় করে নমস্কার করেন,'আমি প্রণব আমাকে সবাই অ্যাডমিন বলে কিন্তু আমি মনে করি আমি গুড ফর নাথিং। মাঝেমধ্যে আমাদের দেখা দেবেন। আর শারীরিক অসুবিধা অনেকেরই আছে ওসব ভাববেন না। মন ভালো রাখবেন। তাহলেই সব সেরে যাবে।'
      ললিতা হঠাৎই উৎপলবাবুর দিকে তাকায় দেখে চরম বিরক্তিভরা মুখটা। তারপরেই আবার গদগদ হয়ে উঠে বলে,'আরে ছাড়ুন তো ঘরে বসে থাকবে তো কী আর হবে? এবার বলুন আপনার গিন্নী কোথায়? আলাপ করাবেন তো?'
         -' আরে ম‍্যাডামের একটু সাজুগুজু করে আসতে সময় লাগবে। আমি মাঝে একবার যাবো ম‍্যাডামকে আনতে। বলেছে আমাকে গিয়েই আনতে হবে।'
    উৎপলবাবু মনে মনে গজরান,বৌকে নিয়ে যত আদিখ্যেতা। একেই নিজের বাড়ির কাছে জায়গা ঠিক করেছে তাতেও হচ্ছে না। সবাই বৌ নিয়ে চলে এলো,আর উনার গিন্নী সাজুগুজু করে এইটুকু পথ আসতে পারল না!
             ললিতা খেতে খেতেই দেখলো তার কর্তা ছোটাছুটি করে সবার পাতে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছেন পরম উৎসাহে। হাসি,মজা আর তামাশায় বেশ হইহই করে মজে রয়েছেন সবার সাথে।
     এই মানুষটার সাথে বাড়িতে দেখা মানুষটাকে মেলাতে পারেন না ললিতা। কখনও ভালো করে একটা কথা শোনা তার কপালে জোটে না। মাঝেমধ্যে নিজের প্রতি নিজেরই করুণা হয় ললিতার।
     এমন অসুখ ভগবান দিলেন যে ভালো করে হাঁটাচলা করতেও পারেন না। যদিও বাবা মেয়ে দুজনেই বলে ললিতাও দায়ী এইজন‍্য। নিজের প্রতি উদাসীন হওয়ার জন‍্য আজ এমন অবস্থা। শুধু খেয়েছো আর ঘুমিয়েছো।
       সবার মন জোগানোর নিজের অতীতের দিনগুলো আর মনে করতে চান না ললিতা। সত‍্যিই এখন নিজেকে দায়ী মনে হয় ললিতার,এখন সব শেষ করে আর নিজের প্রতি মনোযোগী হয়ে কী হবে?
     এই গ্ৰুপের অ্যাডমিনকে বেশ ভালো লাগলো ললিতার,খুব আন্তরিক কথাবার্তা। 
    আসলে কথাই কাঁদায়,কথাই হাসায়। তাই ললিতাও হেসে ফেললেন।
    ওর হাঁটাচলার অসুবিধার কথা শুনে উৎপলবাবুকে বলে ফেললেন,' আরে দাদা এখন একটাই অসুখ একাকীত্ব। বৌদির অসুবিধা তো কী? আপনিই হাত ধরে নিয়ে বেরোবেন সকালে বা বিকেলে। দেখবেন বাইরের হাওয়া গায়ে লাগলেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবে।'
     'তাহলেই হয়েছে,আপনি তো বলেই খালাশ। যাক চলুন এবার খেয়ে নেওয়া যাক। সবাই আপনার অপেক্ষায় ওদিকে। আমাদের পুরুষ টিমের তো খাওয়া হয়নি,লেডিজ ফার্স্ট বলে ওদেরটাই আগে হল।'
         তবে ললিতার এখানে বেশ লাগছে অনেকটা বড় জায়গায় প্রচুর মানুষের মাঝে। কয়েকজন বেশ ভালো। অনেকদিন বাদে গরম গরম লুচির আস্বাদে মনটাও ভালো হয়ে গেছে।
   ওদের ব্রেকফাস্টের পর একটা ছোট ইভেন্ট ছিল যেমন খুশি। ললিতাকে আর উৎপলবাবুকে ধরতে হয়নি,অন‍্যদের সাথে গল্প করতে করতেই একজনের হাত ধরে চলে এসেছেন জায়গা মত।
      দূর থেকে ওর কর্তাটিকে দেখতে পান অনুষ্ঠানের জোগাড়যন্ত্র করছেন অন‍্যদের সাথে হাত লাগিয়ে।
    ললিতা পাশের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে,'এবার কী হবে?'
   'এবার যে যা পারে তাই শোনাবে,আর কর্তা গিন্নীর কিছু পারফরম্যান্স। আপনি রেডি হয়ে এসেছেন তো বৌদি? দাদা কিন্তু বেশ ভালো পাঠ করেন।'
     ললিতা চুপ করে যায়,সেই কোন যুগে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন কেউ কখনও উৎসাহ দেয়নি বরং বিরক্ত হয়েছে সেই অভিমানে নিজেও ভুলেছেন একটু একটু করে যা জানতেন।
          এখনও মাঝেমধ্যে একলা ঘরে মন উতলা হয় গান আর আবৃত্তি শুনলে। মনে হয় তিনিও তো খারাপ গাইতেন না আর আবৃত্তিও বেশ করতেন। নাটকও করেছেন স্কুলে আর কলেজে। সবই ডুবে গেছে এখন কালের অতলে।
       যাক বসে বসে দেখবেন যা অনুষ্ঠান হবে। মাঝেমধ্যে ব‍্যথাতে কষ্ট হয় একভাবে বসে থাকতে। আজকে যদিও ব‍্যথার একটা ওষুধ খেয়েই এসেছেন যদি একটু ভালো থাকা যায়।
               উৎপলবাবু স্পীকারের সামনে দাঁড়িয়ে একটু সাউন্ড টেস্টিং করলেন। তারপর বীথি নামের মেয়েটার সাথে চেয়ারে বসে পাঠ দেখতে লাগলেন। সবাই কী সুন্দর সেজেগুজে এসেছে। তারমধ‍্যে নিজেকে দেখতে বেমানান লাগছে ললিতার।
          একটু বাদেই আবার মাইক্রোফোনে উৎপলবাবুর গলা পাওয়া যায়..'সবাই রেডি তো? আমরা একটু অপেক্ষা করব আমাদের অ্যাডমিন সাহেব এসে পড়লেন বলে উনি এলেই শুরু করব।'
   ললিতা দেখলো কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা ছুটোছুটি করছে এদিক ওদিক বল নিয়ে। কেউ বা ব‍্যাডমিন্টন খেলছে।

       একটু বাদেই কয়েকজন হৈ হৈ করে ওঠে ঐ তো প্রণবদা আর বৌদি আসছেন। উৎপলবাবু তাড়াতাড়ি  এগিয়ে যান সামনের দিকে কয়েকজনের সাথে। মনে অবশ‍্যই একটু উৎসাহ আছে অ্যাডমিন পত্নীকে দেখার। কারণ প্রণববাবুর প্রোফাইলে দেখেননি কোন ব‍্যক্তিগত ছবি।
        তবে সামনে এগিয়ে যা দেখলেন তাতে অবাক হয়ে যান। একটা হুইল চেয়ারে বসা ভদ্রমহিলাকে যত্নে দুহাত দিয়ে ধরে ঠেলে নিয়ে আসছেন প্রণববাবু।
     ওদের দেখেই একগাল হাসি দুজনেরই মুখে।
 'দেখো বেলা তোমাকে স্বাগত জানাতে কতজন এসে পড়েছেন। দাঁড়াও তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দিই,এই যে উৎপলদা,ও বিনু,এই কাকলি আর ঐ যে বীথি। আরও সবাই আছে ওদিকে। অবশ‍্য তুমি তো অনেককেই চেনো মানে এই গ্ৰুপের সবার মুখ তোমার মুখ বইয়ে দেখা তাই না?'
      উৎপলবাবু দেখেন স্বামীর কথায় হাসি ছড়িয়ে গেছে ভদ্রমহিলার মুখে। হাত তুলে নমস্কার জানান সবাইকে।
            গিন্নীকে সাজুগুজু করিয়ে পরে আনার সবটাই পরিস্কার হয় সবার কাছে হয়ত। ততক্ষণে ওরা এসে পৌঁছে গেছেন সবাই যেখানে আছে। প্রণববাবু বেলাকে সবার সামনে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। 
      ললিতা অবাক চোখে দেখছে সবটা,হঠাৎই মনে হল নিজের সমস‍্যাকে সত‍্যিই ভীষণ বড় করে দেখে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন এক অজ্ঞাতবাসে। দিনরাত রোগ আর রোগের কথা ভেবে ভেবে সত‍্যিকারের রুগী হয়ে গেছেন।
      তার থেকেও তো কত শারীরিক সমস‍্যা নিয়ে মানুষজন আছে। তারা যখন ভালো আছে তিনিও পারবেন ভালো থাকতে। আনমনা ললিতার সামনে ততক্ষণে প্রণববাবু এসেছেন বেলাকে নিয়ে।
  ' বৌদি এই যে বেলা আমার গৃহলক্ষ্মী,আর বেলা এই হচ্ছে উৎপলদার'. বাকি কথাটা বেলাই বলে দেয়,'বুঝতে পেরেছি এই হচ্ছে উৎপলদার গৃহলক্ষ্মী। আমাকে নিয়ে এমন মজা করে সব সময়। লক্ষ্মী না লক্ষ্মীছানা কী আমি কে জানে? আমাকে একদম বাচ্চা মেয়ে ভাবে এখনও।'

       বেশিক্ষণ আর কথা হয় না অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। যদিও উৎপলবাবু ওখান থেকেই চোখ রেখেছিলেন ওদের দিকে,অদ্ভুত একটা বিস্ময় এখনও তার। কী করে এমন হল কে জানে?
            বেশ জমে উঠলো অনুষ্ঠান এর ফাঁকেই অনেকেই ফিসফাস করল বেলাকে নিয়ে। তারা ভাবেইনি যে প্রণবদা এত ভালো মানুষ আর সমাজসেবী তার স্ত্রীর এমন একটা অসুবিধা আছে। নিজেও কখনও বলেননি। তাই বোধহয় কোন ছবিও দেন না,আর তেমনভাবে পরিবারের কথা কোথাও বলেন না।
      তবে এবার তো প্রণবদাই বললেন সবাইকে জোড়ে আসতে হবে।
     বেলা খুব সুন্দর গান গায়,ওরা কর্তা গিন্নী মিলে সবার অনুরোধে দুটো গান গাইলো।
    উৎপলবাবু আর বীথির পাঠটাও বেশ সুন্দর হয়েছে। ললিতা চেয়ারে বসেই কয়েকটা ছবি তোলেন আর কিছুটা ভিডিও,মেয়েকে পাঠাবেন বলে। যদিও এসব ব‍্যাপারে খুবই অপটু তিনি।

        প্রণববাবু বলেন,'আমাদের কথা ছিল জোড়ায় আসার সবাই কথা রেখেছি আমরা। এছাড়াও বলা হয়েছিল প্রত‍্যেককে কিছু করতে হবে জোড়ে,ছোটখাটো যা কিছু। সেটাও হচ্ছে,তবে উৎপলদা কিন্তু এখনও বৌদির সাথে কিছু করেননি।
    মাংস প্রায় রেডি আর আধঘণ্টার মধ‍্যে আমরা খেতে বসবো। যারা এখনও বাকি তাদের নাম এখন আমি বলব।'
      উৎপলবাবু বিরক্ত হন মনে মনে বলেন নিজের গিন্নী গান জানে দুজনে মিলে গেয়ে ফেলে হাততালি কুড়োলো। তার ঘরেরটি তো তেমন কিছুই জানে না যে করবে। এসব ব‍্যাপারে কোন উৎসাহ কোনদিনই দেখেননি,বিয়ের পর দু চারদিন সারেগামা বাজাতো কিন্তু মা বিরক্ত হত সকালে বিকেলে বৌ প‍্যাঁ প‍্যাঁ করে হারমোনিয়াম বাজায় ঘরের কাজ না করে বলে সেও অভিমান করে বন্ধ করেছিল সেই কবেই। উৎপলবাবু শাশুড়ি বৌমার মান অভিমানের মধ‍্যে কারও পক্ষই তেমনভাবে নেননি,বলতে গেলে মায়ের পক্ষই নিয়েছিলেন চুপটি করে মনে মনে। সুতরাং গিন্নীর অভিমানের ফলে তালা ঝুলেছিল হারমোনিয়ামের বাক্সে। তারপর আর তেমনভাবে খোলেনি কখনও।
       আর এখন তো দিনরাতই একটাই কথা এখানে ব‍্যথা আর সেখানে ব‍্যথা।
    অবশ‍্য গান বলতে তেমন কিছুই জানত না। সুতরাং বন্ধ হওয়াতে কিছু এসে যায়নি এই মনে করেই নিজের বিবেককে শান্ত করেছিলেন উৎপল বাবু।ঐ একটা দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত,শ‍্যামাসঙ্গীত আর দুটো একটা নজরুল গীতি।
  উৎপলবাবুর চিন্তার জাল কেটে যায় হঠাৎই মাইকে বেজে ওঠে তাদেরই নাম। আরে প্রণবটা করছে কী? বারবারই বলছে উৎপলদা বৌদিকে নিয়ে আসুন। এবার কিন্তু আপনাদের পালা। আপনাদের দিয়েই আমরা ইতি টানবো এই দম্পতি সম্প্রীতির। কথা খুব সুন্দর বলে প্রণব এটা মানতেই হবে।
     অবশ‍্য উৎপলবাবুও কম কী? তার গলাতে যে আবেগ আর আবেশ আছে তাতে ফোনে কথা বলে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে যায়।
   আরে এরা করছে কী? উনি কিছু বলার আগেই ওরা ললিতাকে নিয়ে স্টেজে তুলে দেয়। উৎপলবাবুর সত‍্যিই অস্বস্তি হয়,এ নির্ঘাত লোক হাসাহাসির একটা ব‍্যাপার হবে। ললিতার দিকে চোখ যেতেই দেখে ও কেমন যেন একটা করুণ মুখে তাকিয়ে উনার দিকে।
       প্রণব আবার বলে,বৌদি কিন্তু রেডি..দাদা চলে আসুন তাড়াতাড়ি। সবাই কিন্তু আপনাদের অপেক্ষায়। কারণ আপনারা মধুরেণ সমাপয়েৎ করলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সবাই গরম গরম খাবারে। মুচমুচে হবার জন‍্য সবেই বেগুনী ভাজা কড়াইয়ের তেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
      অনিচ্ছাসত্ত্বেও উৎপলবাবু পা বাড়ান স্টেজে তবে তার আগেই ললিতার গলা পেয়ে অবাক হয়ে যান।
   ললিতা বলছে,'আজ এখানে এসে আমি সত‍্যিই একটা খোলা আকাশ আর একমুঠো তাজা বাতাসে সিক্ত হলাম। শারীরিক অসুবিধার জন‍্য তেমনভাবে বাইরে বেরোনো হয় না আজকাল। সেইজন‍্য প্রণব ভাইকে অনেক ভালোবাসা। ভাই বললাম,কিছু মনে কোর না। অনেক আগে একটা দুটো গান জানলেও আজ আর তা চর্চার অভাবে অবশিষ্ট নেই। তবুও আজ আমাদের প্রথম আর শেষবারের মত একসাথে গাওয়া একটা গান গাইবার চেষ্টা করছি আশাকরি উনিও গলা মেলাবেন আমার সাথে।'
         অবাক হয়ে যান উৎপলবাবু ললিতার সপ্রতিভ কন্ঠে কথা বলাতে। আজকাল ওর দিকে তাকাতেও তেমনভাবে ইচ্ছে করে না আর। প্রয়োজনের বাইরে কথাও তেমন হয় না। আর কীই বা কথা বলবেন? এত বছর পার করে আর কী কথাই বা থাকতে পারে?
        ললিতা গাইছে সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা। গানটা শুনে হঠাৎই অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় উৎপলবাবুর,তখন আর কতই বা মাইনে পান? ললিতাকে নিয়ে বিয়ের পর গিয়েছিলেন মধুপুর। সেদিন ছিল বাসন্তী পূর্ণিমার রাত। চারদিক তখন রূপোলী আলোতে স্নান করছে। উৎপলবাবুর অনুরোধেই ললিতা গেয়েছিল এই গানটা। তারপর একটা সময় উৎপলবাবুও গলা মিলিয়েছিলেন। হেমন্তের এই পড়ন্তবেলায় সেই গানটা অনেক কিছু আজ হঠাৎই মনে করিয়ে দিল।
   ললিতা গাইছেন গলাটা একটু কাঁপলেও খুব ভালো লাগছে,সবাই শুনছে। সেই জায়গাটাতে এসে উৎপলবাবুর দিকে তাকান ললিতা। উৎপলবাবুর বিরক্তির ধুলোমাখা পর্দাটা হঠাৎই উড়ে যায় অতীতের একমুঠো মিঠে স্মৃতির ঝাপটায়। উৎপলবাবু গেয়ে ওঠেন ললিতার সাথে যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে,দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কী মহা লগনে....
      ললিতার মন অতীতের ভালোলাগায় ডুবে যায়,উৎপলবাবুর মনে পড়ে সেই জোছনাভরা রাতে সারা রাত জেগে চাঁদের আলোতে নতুন বিয়ে করা ললিতার সাথে কাটানো মিষ্টি মধুর মুহূর্তগুলোর কথা। তারপর ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়া একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দৃঢ় বন্ধনে।
       গান শেষ হয়ে গেছে। সবাই হাততালি দেয় দাঁড়িয়। প্রণব বলে ওঠে,'উৎপলদা বৌদির আলো ঝলমলে মুখটা কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানের অনেক বড় প্রাপ্তি।
   সকাল থেকে দেখা ম্রিয়মান মুখটা কী সুন্দর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যখন আপনিও গাইছিলেন সাথে। অনেক ধন‍্যবাদ বৌদি আমাদের আবদার রাখার জন‍্য।'
   ললিতার দিকে তাকান উৎপলবাবু,একটু লালচে হয়ে যাওয়া গালদুটোতে তখন হঠাৎই অনেক কিছু পাওয়ার উচ্ছ্বাস আর চোখের কোণায় দু ফোঁটা জল।
    এমন অনেক জলই হয়ত ব‍্যথা আর অবহেলার যন্ত্রণায় ফেলে ললিতা গোপনে। তবে আজকের এই জল আনন্দের আর ভালোলাগার।
        উৎপলবাবু ললিতার হাতটা ধরেন শক্ত করে। ললিতা যেন অনেক সহজেই পা ফেলতে পারে মাটিতে। ব‍্যথাটা আর তেমন লাগে না। উৎপলবাবুর হাতের বন্ধনটা এতই দৃঢ় এখন ললিতার মনে হল তুমি যদি এভাবে পাশে থাকো তাহলে হয়ত অনেক কষ্টই হাসিমুখে জয় করতে পারব।
                 অনুষ্ঠান অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। যে ফাঁকটুকু আর ফাঁকিটুকু নিয়ে ললিতা আর উৎপলবাবু এখানে এসেছিলেন অনুষ্ঠানের মাধুর্যে হয়ত সেটা অনেকটাই পূরণ হয়ে গেল হঠাৎই। হয়ত বা প্রণব আর বেলার বন্ধনই চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো উৎপলবাবুকে যে দাম্পত‍্যকে কিভাবে আগলে যত্নে রাখতে হয়।
     আসলে দাম্পত‍্য অনেকটা আমাদের নতুন বাড়ির মত,প্রথম যখন গৃহপ্রবেশ করে সেই বাড়িতে আসি তখন কত সুখ মনে। কত ইচ্ছেই জাগে বাড়িকে সাজাতে আর যত্ন করতে। একটা সময় সেই বাড়ি পুরোনো হয়,ধুলো জমে আনাচে কানাচে। ঠিক আমাদের সম্পর্কের মতই। আমরা অভ‍্যস্ত হয়ে যাই দিনগত পাপক্ষয়ে। তারপর আবার কোন একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষ‍্যে সেই বাড়িকে ঝাড়পোছ করে রঙ করা হয় আবার বাড়িটা পুরোনো হয়েও হেসে ওঠে। আমাদেরও মনটা খুশি হয়ে ওঠে নতুন নতুন গন্ধে।
     দাম্পত‍্যও ঠিক তেমনি সময়ের থাবায় তা হয়ে ওঠে পুরোনো বাড়ির মত। চামড়াতে ভাজ পড়তে থাকে,বয়েসের থাবায় রুক্ষতা বাড়ে ত্বকে,মনে আর কখনও বা স্বভাবেও। আর হয়ত তখনি মাঝেমধ্যে কিছু রঙ আর যত্নের দরকার সম্পর্কে। হয়ত বা আজ হঠাৎই কিছুটা রঙের ছিটে পড়লো উৎপলবাবু আর ললিতার ফিকে সম্পর্কে।
             উৎপলবাবু শক্ত হাতে ধরেছেন ললিতার হাত সেই হাতের ছোঁয়ায় নিজেকে বড় তৃপ্ত লাগে ললিতার। এখানে যখন এসেছিলেন সেই অপমান আর অভিমানের মেঘ কেটে গেছে অনেক আগেই। উৎপলবাবু বলেন,'মাথাটা এখানে রাখো ললিতা। আজ তোমার অনেক ধকল গেছে। শরীরটা ঠিক লাগছে তো?'
     ললিতা কোন উত্তর দিতে পারেন না,আজ মনটা যে বড় ভেজা। বেশি কথা বললে যদি বৃষ্টি নামায় চোখদুটো? তাই উৎপলবাবুর হাতের মুঠোটা শক্ত করে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখেন পরম নির্ভরতায়। গাড়ি ছুটে চলে হাইওয়ে দিয়ে পাশাপাশি ছুটছে রূপোর থালার মত চাঁদটাও,আজ বোধহয় পূর্ণিমা।
           
    


           

      

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...