বিতর্কিত মহাকুম্ভে
আমরা যখন মহাকুম্ভে পা রাখলাম তখন তা কারও কাছে মৃত্যুকুম্ভ,কারও কাছে বিষকুম্ভ আবার কারও কাছে অমৃতকুম্ভ। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে রীলের ছড়াছড়ি,পরিচিতজনের সতর্কবার্তা সব মিলে অনেক দোটানায় পড়েও মনকে একাগ্ৰ করেছিলাম যাবই বলে। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এখন নিজেকে নিঃশব্দে অনেক বিষ পান করে নীলকন্ঠী বলেই মনে হয়। শিবঠাকুরের শুধু গলাটুকু নীল আর কালের থাবায় বিষ পান করে আমাদের সারা শরীর,মন সবই জর্জরিত। তাই ভাবলাম একশো চুয়াল্লিশ বছর পরে যে যোগ এসেছে সেখানে গিয়ে যদি আরও কিছু বিষ পান করতে হয় তো হবে। আর যদি মহামিলনের যজ্ঞশালায় নিজের মনকে আহূতি দিয়ে কিছু লোভ, হিংসা আর পরশ্রীকাতরতা পুড়িয়ে আসতে পারি সেটাই বা কম কী? তবুও একান্তে নিজেই মনকে জিজ্ঞেস করেছি কী করে এত রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মহাকুম্ভে যাব? এত বছর তো কুম্ভ এসেছে কখনও ভাবিনি যাব বলে অথচ এবার কেন যাবার এত অদম্য ইচ্ছে? সত্যিই কী তবে সময় হয়েছে? মা বলতেন সব কিছুর সময় আছে,ভগবান না ডাকলে যাওয়া যায় না। তাহলে বোধহয় ভগবানই ডাকছেন। যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল ছেলে আর থাকার এবং ফেরার সব ব্যবস্থা করল আমার কলিগ বোন। পরিচিত মহলে শুনেছি পাপ ধুতে যাচ্ছে লোকজন,আর সেই পাপের বোঝা বয়ে ক্লান্ত সঙ্গম। মিডিয়ায় দেখেছি কুম্ভের জলে থিকথিক করছে জীবাণু। টিকা টিপ্পনী শুনেছি আমরা পাপী নই যে কুম্ভে যাবো,কুম্ভ নিয়ে হিড়িক চলছে,এটা নেহাতই হুজুগ। মনে মনে ভাবলাম ঐ দুর্গা পুজোর ভীড়ের মত জুতো ক্ষইয়ে সাতদিন আগে থেকে ঠাকুর দেখার মত হুজুগ আর কী? মৌনী অমাবস্যায় মানুষজন মারা গেল হুজুগে পড়ে,পদপিষ্ট হল লোকজন দিল্লীতে তবুও কুম্ভের হুজুগ কমল না।
যারা ফেসবুক করে না,রীল দেখে না তারাও মাইলের পর মাইল হেঁটে মাথায় পোটলা নিয়ে রওনা দিল আবার সব ভুলে চলো কুম্ভ চলো বলে। আমরা ফেসবুক করি,খবরে চোখ রাখি,রীল দেখি তবুও আমরাও এত কিছুর পরেও ওদেরই সাথে পা মেলালাম চলো কুম্ভ চলো বলে মনের সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে ভগবানের নাম করে। পৃথিবীর সব জাতি যদি নিজের ধর্মকে শ্রদ্ধা করে তবে আমি আমার ধর্মকে শ্রদ্ধা করব এতে লজ্জা কোথায়?
যেখানে এত মানুষের ঘাম,শ্রম,কান্না,হাসি আর পদচিহ্ন জড়িয়ে সেটাই তো এই ভারতের মহামানবের সাগর তীর। প্রয়াগরাজে পৌঁছে দেখলাম স্টেশনে মানুষের ঢল,পা মেলালাম ওদের সাথে। দেখলাম নব্বই বছরের মাকে মেয়ে,বৌরা দুদিক ধরে তুলে আনছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,' কিঁউ লায়া?'
মুখে হাসি মাখিয়ে উত্তর দিল মায়ের শেষ ইচ্ছে তাই পূরণ করতে এনেছি। মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় হবে পূরণ। পথে দেখলাম খালি পায়ে ছেলে চলেছে ভীড়ের মাঝে হুইল চেয়ারে মাকে বসিয়ে সঙ্গমের উদ্দেশ্যে। হয়ত এটাও মায়ের শেষ ইচ্ছে,কেন যেন মনে হল মহা কুম্ভের পূর্ণতা এখানেই। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন সেই ছোটবেলায় পড়া শ্রবণ কুমারের গল্প যে তার অন্ধ পিতা আর মাতাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে তীর্থে নিয়ে গিয়েছিল।
কখনও পিতা পুত্রকে পিঠে নিয়ে চলেছে,আবার কোথাও পুত্র পিতাকে হুইল চেয়ারে,বৃদ্ধা পত্নী চলেছেন পতির হাত ধরে দুজনের হাতেই লাঠি। নৌকোতে হুইল চেয়ারে বাবাকে বসিয়ে প্রহরী পুত্র,হয়ত শেষ ইচ্ছে পূরণেই পুত্রের অমৃতের আস্বাদন। অমৃতের ভাগ অসুররা পায়নি,এই কলি যুগে আমরা যে অমৃতকুম্ভে স্নান করে পুণ্যের ছিটেফোঁটা পাব সেই আশা নাইবা করলাম। তবে কুম্ভে দেখলাম মানুষের মেলবন্ধন,দেশী,বিদেশী,দীন,দরিদ্র,ধনী,মন্ত্রী,আমলা,সাধু,সন্ন্যাসী,পাপী,তাপী কত কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু যে যেখান থেকে যেভাবেই আসুক না কেন সবাই ডুব দিয়েছে সেই একই সঙ্গমে। ঘাট হয়ত আলাদা কিন্তু জলের ধারাকে বাঁধে সেই সাধ্যি কার আছে? আমরা যখন বোটে করে সঙ্গমে আসছি তখন যমুনায় জল কম,যমুনা পেরিয়ে এলাম সেই জায়গায় যেখানে গঙ্গার সাদা জল আর যমুনার কালো জল মিশেছে সরস্বতী অন্তঃশলীলা। যে জলের বড়ই দুর্নাম শুনেছিলাম জীবাণু থিকথিকে বলে নিশ্চিন্তে হাঁটু অবধি সেই জলে নুয়ে পড়ে সমর্পণ করলাম নিজেকে হর হর মহাদেব বলে। পরম শান্তিতে ভরে উঠলো দেহ আর মন। কী অপার স্নিগ্ধতা আর শীতলতা নিমেষে মুছে দিলে এতদিনের সমস্ত উৎকণ্ঠা আর পথশ্রমের ক্লান্তি। অবশ্যই সেই অনুভূতি হয়ত প্রত্যেকের একান্ত আর ব্যক্তিগত। তবে আমরা অভিভূত। বেলা তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যের সন্ধিক্ষণে আকাশে প্রায় অস্তগামী সূর্যের লাল আভা দেহ আর মন তখন পরিতৃপ্ত এক অনন্য অনুভূতিতে। তীর্থযাত্রার পথ মসৃণ নয়,বাধা,প্রতিকূলতা,সমস্যা থাকবেই তবুও দু চোখ ভরে দেখেছি হাজার হাজার মানুষের ছুটে চলা। প্রশ্ন করেছি বারবারই কী আছে এখানে? মেলা দেখা? না,সেসব তেমন কিছুই নয়। নেই কোন আলোর ঝলকানি,জাকজমক,নেই কোন বিলাস তবুও মানুষ ছুটে চলেছে আর ছুটেই চলেছে...সমুদ্র মন্থনে উঠেছিল গরল সেই গরলের পর এসেছিল অমৃত। অমৃতের স্বাদ সবাই পায় না,অমৃতের সন্ধানে এসে কত লোকের ঠাঁই হল মৃত্যুলোকে। তবুও প্রয়াগরাজের বাতাসে আকাশে একটাই আওয়াজ সঙ্গম যাওগে?
স্নান শেষ, পরদিন ঘরে ফেরার পালা। ফাঁকা অটো এসে জিজ্ঞেস করলো সঙ্গম যাওগে? উত্তর দিলাম ভাঙা হিন্দীতে নহী,হো গয়্যা স্নান। পথে আসতে আসতে দেখলাম মেলা প্রাঙ্গনের কোন শেষ নেই,আর শেষ নেই মানুষেরও হাতে দড়ি বেঁধে তারা চলেছে নরদেবতারূপে মাথায় পবিত্র সঙ্গমের বারিধারা নিয়ে।মনে মনে বললাম কবিগুরুর লাইনগুলো...
হেথায় দাঁড়ায়ে,দু-বাহু বাড়ায়ে
নমি নর দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে
বন্দন করি তাঁরে।
Comments
Post a Comment