বিয়ের পর একটা সময় চৈত্র মাস এলে রুক্ষ শুকনো গালেও একটু হলেও লালচে আভা লাগত যে বর নিয়ে যাবে সেলের বাজারে। কলকাতা আসার পর এই সেল নামক বস্তুটির সাথে সেই আমার পরিচয় ঘটায়। তবে চৈত্র শুরুর সেলের বাজারে যাওয়া সম্ভব হত না কারণ তখন চাকরি বাকরি করি না হাতে টাকা পয়সা তেমন কিছুই থাকত না। সাংসারিক কারণে বর তেমনভাবে কখনই হাতে টাকা পয়সা দিতে পারেনি। অবশ্য পরে না দেওয়াটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। ঐ টুকটাক যা প্রয়োজন তা নিজের সাধ্যমত কিনে দিত। বাবা এলে যাবার সময় প্রতিবারই হাতে দু একশো টাকা দিয়ে যেত। সেগুলো যত্নে আগলে রাখতাম বিএডের চার্ট পেপার,খাতা,ফাইল,পেন পেন্সিল কিনব বলে। আর মাঝেমধ্যে হাতে কিছু বাঁচলে হেদুয়া পার্কের সামনের আচারওয়ালার কাছ থেকে বিটনুন দিয়ে বনকুল মাখা কিনতাম। ঠোঙাটা সযত্নে ধরে উঠে বসতাম ট্রামে তারপর ট্রামের টুংটাং ঘন্টি শুনতে শুনতে একটা করে কুল মুখে দিয়ে তার স্বর্গীয় টক,ঝাল,মিষ্টির স্বাদে ডুবে যেতে পৌঁছে যাওয়া বাড়ি। তার মাঝেই অবাধ্য চোখ দেখত ট্রামের চাকা থমকে গেলে হাতিবাগানে বসেছে কত না জিনিসের পসরা। আর লোকেরা ভিড় করে সেগুলো কিনছে। হকারদের তারস্বরে হাতে জামা নিয়ে চিৎকার সেল,সেল। যত কথা হত বরের সাথে সে অফিস থেকে ফিরলে। এক কাপ চা নিয়ে সে বসত মাটিতে আর আমি খাটে বসে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলতাম,জানো আজ অনেক দেরি হয়েছে পৌঁছোতে,হাতিবাগানে সেল চলছে। কত ভিড় জমেছে,লোকে কত্ত কী কিনছে। এত কিছু লোকে কেনে? সে হেসে বলত মাইনে পাই তোমাকেও নিয়ে যাব সেলের বাজারে। প্রতিদিনই কলেজ থেকে ভিড় বেয়ে আসার পথে চোখে পড়ত কত কিছু বেচাকেনা হচ্ছে। তারপর বরের মাইনে হত মাসের প্রথমে,বেকার বৌকে একটু খুশি দেওয়ার জন্য কর্তা তার কথার খেলাপ না করে নিয়ে যেত সেলের বাজারে। তবে সেটা অবশ্যই শনিবার কারণ সপ্তাহের শেষের ঐ দুটো দিন তার ছুটি থাকত। শ্যামবাজার মোড়ে নেমে রাজ্যের ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে কে.সি দাসের দোকান থেকে ছেলেদের কিছু জিনিস, হিন্দুস্থান টেক্সটাইল থেকে ছাপা শাড়ি একটা দুটো ব্লাউজ কিনে খুশি হয়ে বাড়ি ফেরার পালা। এইটুকু কিনেই পকেট আর শরীর দুইই হাল্কা মোটামুটি তবুও মনটা কিন্তু বেশ ফুরফুরে তখন। কারণ হাতে ঝুলছে বরের পছন্দ করে দেওয়া সাদার ওপর ছোট্ট ছোট্ট কালো ব্লক প্রিন্টের শাড়িখানা। দোকানের আয়নাতে গায়ে ফেলে বেশ লাগছিল দেখতে। বলি চলো বাড়ি যাই,অনেক কিছু কেনা হয়ে গেছে। সে বলে,কিছু খাবে না? এতটা ঘোরাঘুরি হল। খুব গরম লেগে গেছে। আর কিছু কিনবে তো বলো। আমি মাথা নাড়ি সঙ্কোচে। তারপর দুজনে মিলে ম্যাড্রাস টিফিনে ঢুকে মশলা ধোসা আর কুলফি খেয়ে বাড়ি ফেরা।
তখন শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরতাম না,তাই বাড়ি এসে কতবার আয়নাতে শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখা। তারপর পয়লা বৈশাখের পরে ঘরের রান্না সেরে,ঘাম ভেজা মুখটা মুছে ঐ শাড়ির সাথে ছোট্ট একটা অক্সিডাইজডের ঝুমকো পরে আবার ট্রামে বসে কলেজে যাওয়া। চৈত্র সেলের বাজারের ভিড় ঠেলে,সাদা মাটা গেঞ্জি পরা এক বর তার এত্ত বড় একটা টিপ পরা বৌয়ের হাত ধরে রাস্তার ভিড় ঠেলছে সস্তার দিনে একটু আনন্দের হাসি ফোটাতে বৌয়ের মুখে এ চিত্র বেশ কয়েক বছরের। দিন গেছে বয়ে আমি বেকার থেকে স্বকার হয়েছি,তবে তখনও সরকারের দয়ায় মাইনে হত মাসের শেষে। আর সেই টাকাও ছিল অল্প অথচ মাথায় ছিল অনেক দায়িত্বের বোঝা সুতরাং সেলের বাজারে গেছি বহুদিন। বেশ কয়েকবছর তার সাথে গেছি,তারপর কখনও একা কখনও মায়ের সাথে গেছি। ব্যাগ ভরে বাজার করে এনেছি। বিয়ের পরপরই এমনি এক সেলের দিনে বরের সাথে গেছিলাম কলেজস্ট্রীটে সেখানে এক দোকানে ছাপা শাড়ি কিনতে গিয়ে পেয়েছিলাম মা লক্ষ্মীর একখানা ক্যালেন্ডার। ঠাকুরের জায়গায় রেখে পুজো করেছিলাম, আজও করি। মা লক্ষ্মীর কৃপা হয়েছিল এই বাউন্ডুলে,অকম্মা মেয়েটার ওপর তাই কিছুদিন বাদে ম্যাড্রাস টিফিনে গেলে বিলটা আমি দিতে পারতাম,বিএড কলেজের দিনগুলোর মত আর না খেয়ে থেকে বন্ধুদের রোল বা ফুচকা খাওয়া দেখতে হত না। সেলের বাজারের সস্তার শাড়ি খুঁজে খুঁজে কিনতে হত না। কিন্তু কোথায় যেন কিছু অভ্যেস রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায়। কষ্ট সহ্য করতে করতে কষ্ট সওয়ার অভ্যেস হয়ে যায়,অপমান হজম করাটাও অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। তাই এখনও বেশি কিছু করতে গেলেই মনে হয়,বেশি খরচ করে ফেলছি না তো? পঞ্চাশ টাকা মিটারে বেশি চাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ছেড়ে বাসে উঠে বসি। যাদের কাছে অপমানিত হয়েছি তাদের সাথে গলা মেলাই,দাঁত ক্যলাই। একসময় আমার জীবন যারা জর্জরিত করে তুলেছিল তাদের খারাপ সময়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়াই। আসলে জীবনটাই একটা সেলের বাজার প্রতিনিয়ত যে কত কিছু বেচতে হয় এখানে একটু আনন্দ আর খুশি কিনতে তা বোধহয় আমরা নিজেরাও ভুলে যাই একটা সময়।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
কোয়েল এই নামটার মধ্যেই এক অপূর্ব মিষ্টতা লুকিয়ে আছে। কোয়েলের ডাকে আসে বসন্ত আবার কোথাও কোয়েল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মেলে এক অপার আনন্দ,মন চায় দু হাত বাড়িয়ে ছুঁই তার জলকে। কিছুটা সময় বিশ্রাম নিই নদীর বুকে জেগে থাকা পাথরে বসে আর কান পেতে শুনি তার চলার শব্দ আর পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক। পালামৌয়ের জঙ্গল আর কোয়েল নদী এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে বুদ্ধদেব গুহের উপন্যাসে। জঙ্গল যে মনে নেশা ধরায় তা এখন বুঝতে পারি। পালামৌয়ের জঙ্গলের শাল মহুয়ার নেশা মাতাল করে দিতে প্রকৃতি প্রেমিককে। এবার পালামৌয়ের জঙ্গলকে পাশে রেখে আমাদের যাত্রাপথে দু তিনবার দেখেছি কোয়েলকে। বসন্তে কোয়েলের বুকে চর,মাঝেমধ্যে জল আছে সেই জলে আরামে ডুবে রয়েছে মোষেরা। পাশের জঙ্গল থেকে একটানা ভেসে আসছে পাখির ডাক। আমাদের সারথী নেতারহাট থেকে রাঁচি যাবার পথে একদম দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কোয়েলের কাছে সুতরাং আগেরদিনের মত ব্রীজে দাঁড়িয়ে কোয়েলকে দেখা নয় এবার মন ভাসিয়ে দেওয়া একদম কোয়েলের কাছাকাছি এসে। অলস বেলায় বেশ কিছু কাপড় নিয়ে গ্রামের বধূ কাচতে বসেছে,একজন স্নান করছে দূরে। বুকে কতশত পাথরের ভার সেই ভারকে তুচ্ছ করে বয়ে চলেছে নদী। কান পাতলে শোনা যায় তার ঢেউয়ের শব্দ। বুঝলাম এই নদী বর্ষাতে খরস্রোতা,তখন আর সে পাথরের পাহাড়া মানে না খলখলিয়ে অট্টহাস্য করতে করতে বয়ে যায়। এই স্রোত ঠিক জীবনের স্রোতের মতই,যৌবনে যা কোন বাধা মানে না তা বার্ধক্যে এসে হয় শান্ত,ধীর আর ক্ষীণ। কিছুটা সময় কোয়েলের ডাকে সাড়া দিয়ে তার শান্ত রূপ দেখে আবার এগিয়ে চলা আমাদের যাত্রাপথে।
Comments
Post a Comment