বসন্তের সুবাস বাতাসে,প্রকৃতিতে নানা রঙের মেলা সুতরাং উচাটন মনে ঘুরন্তী বাই আবার উতলা করে তুললো আমাদের। এবারের দোলে তাই চলে গেছিলাম ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ। বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল কোথায় যাওয়া যায়? যেখানে পলাশও থাকবে আবার প্রকৃতির রঙও থাকবে,থাকবে একটু পাহাড়,জঙ্গল আর ঝরনা। অবশেষে ঠিক হল ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ। ছোটনাগপুরের মালভূমিতে অবস্থিত ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ এখন ঝাড়খন্ডে। পৌঁছতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না। যে কোনভাবে রাঁচি পৌঁছে গেলেই ব্যাস আর বেশি দূর নয়। রাঁচি থেকে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার মত দূর যেতে সময় লাগে মোটামুটি একঘন্টা পঁচিশ মিনিট। এখানে স্টেশনও আছে তবে সেখানে একটাই ট্রেন দাঁড়ায় তার নাম শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। আমাদের হুট করে পরিকল্পনা সুতরাং ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেল না তাই বাসের টিকিট কাটা হল। দীর্ঘদিন ধরে রেলবাবুর ঘরণী হওয়ার সুবাদে বাসের যাত্রা আমার এখন একেবারেই না পসন্দ। তবুও অগত্যা মানতেই হল। সঙ্গী হল আমার বরের মর্নি ওয়াক গ্ৰুপের কয়েকজন দাদা আর তাদের স্ত্রীরা। যথারীতি বাসে উঠেই আমার আক্কেল গুড়ুম। বরকে আগেই বলেছিলাম আমি ওপরে উঠব না,আমার স্লিপারে ঘুমের দরকার নেই বসে যাবো। কিন্তু আমার কথাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে যথারীতি স্লিপারের টিকিটই কেটেছে ওরা। যদিও আমার বিশাল বপু নিয়ে কষ্টে সরু সিঁড়ি বেয়ে কোনরকমে ওপরে উঠলাম কিন্তু দেখলাম সিঙ্গেল স্লিপার নামক পায়রার খোঁপে ঢুকে আমার অদ্ভুত এক অস্থিরতা শুরু হল। প্রথমেই মনে হল কী করে এপাশ ওপাশ করব? তারপর মনে হল দেহখানা সীটে ফেলার পর তুলব ক্যামনে রে? ভেতরটা পুরো দমবন্ধ ছোট্ট একফালি কোটরের মত প্রবেশ পথ তাতেও আবার দরজা আছে,উরিব্বাস প্রাইভেসির চূড়ান্ত! বরের দিকে তাকিয়ে কাতর অনুরোধ করলাম,হ্যাঁ গো দেখো না যদি কেউ ওপরে আসে তাহলে আমি নিচে নামব। সে একবার কটমটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল যাক কিছু বাদে একটা ছেলেকে নিয়ে এল যে ওপরে উঠতে রাজি। ওঃ বাঁচলাম বলে তাকে গোটা চারেকবার থ্যাঙ্কু জানিয়ে তার সিটে বসে পড়লাম আমি। আমাদের সহযাত্রী এক দিদির অবস্থা তো আরও করুণ তাকে আমাদেরই সহযাত্রী এক দাদা মানে পরপুরুষ তো বটেই তার সাথে তুলে দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে তাদের এটাই সিট নং। তার বরমশাই আবার ওপরে উঠবে না বলে নিচে বসেছে। যাক অনেক খিচুড়ি পাকিয়ে সব জট খুললো। আমাদের ছজনে মধ্যে তিনজন ওপরে আর তিনজন নীচে বসলাম। স্বস্তির শ্বাস ফেললাম যে কোনরকমে রাতটুকু ঝিমিয়ে কাটালেই বাঁচি মানে এসে যাবে রাঁচি।
রাঁচিতে পৌঁছোলাম সাড়ে ছটা নাগাদ,তার মাঝে একবার নেমেছিলাম হাল্কা হতে। ছেলেরা ভোরে নেমেছিল চা খেতে। তখনই ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে থাকে আর সেই আলোতে দেখতে পাই পাশের পথে আর পাহাড়ের কোলে সারি সারি পলাশ গাছ। যতদূর চোখ যায় শুধু পলাশের বন। মন আর চোখ দুইই মুগ্ধ তখন। চোখ যেন সরতেই চায় না। তারপর যতই শহরের দিকে এগোতে লাগলাম পলাশ ফিকে হতে লাগলো। রাঁচিতে বাস থেকে নেমেই দেখি আমাদের গাড়ি চলে এসেছে সুতরাং উঠে পড়লাম তাতে। সে আমাদের কাছের একটা সুলভ কমপ্লেক্সে নিয়ে এল তখনকার মত ফ্রেশ হতে। সবাই মুখ ধুয়ে নিলাম,এবার চায়ের তেষ্টা সুতরাং সামনের দোকানে চলে গেলাম। আসেপাশে তখনই রঙের খেলা জমে উঠেছে। তার সাথে আড়ালে আছে রঙীন বোতল। মাঝেমধ্যে গলাতে ঢেলে আবার রঙ আর আবীরের রঙে একে অপরকে রঙীন করছে। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। প্রকৃতিতে তখন বেশ শীতলতা। আমাদের হোটেল বুক করাই ছিল ওরাই বলে দিয়েছিল আমরা চাইলে পথেই জলখাবার খেতে পারি। গাড়ি কিছু পথ চলার পর এসে দাঁড়ায় বিজুপাড়ায়,এখানে একটা বেশ বড় দোকান আছে সেখানেই আমরা গেলাম। দোকানে হোলি উপলক্ষ্যে হরেক রকমের মিষ্টি সুন্দর বাক্সে সাজানো। ধোসা ইডলি পাওয়া যায় ওখানে তবে সকালে তখন বানানো হয়নি বলে আমরা পুরি সবজি আর জিলিপি খেলাম। এদিকে সবই আটা দিয়ে বানানো, গরম গরম খিদের পেটে ভালো লাগলো। আবার ছুটে চলা গাড়িতে রাস্তার শোভা কিন্তু ভীষণ সুন্দর। দুপাশে সবুজের হরেক বাহার,কোথাও গাছে সবুজ পাতা সদ্য হয়েছে আবার কোথাও সবুজ পাতা সোনালী হয়ে গেছে বসন্তের শেষে ঝরে পড়ে নতুন কিশলয়ের জন্ম দেবে বলে। আর তারই মাঝেমাঝে গোল পাতাওয়ালা রুক্ষ গাছ আলো করে আছে বসন্ত সুন্দরী পলাশ তার আগুন ঝরানো রঙে। রাস্তাও অত্যন্ত মসৃণ সুতরাং গাড়ি ছুটে চলেছে। কিছুটা পথ যেতেই দেখলাম পলাশের গাছেরা জমায়েত করেছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে। সুতরাং আমরাও গাড়ি থামালাম তারপর দাঁড়িয়ে আজলা ভরে তুলে নিলাম অনাদরে পথে পড়ে থাকা পলাশের পাপড়িগুলো। মনও রঙিন হয়ে গেল বসন্তের রঙ খেলার দিনে প্রকৃতির উজাড় করা সুন্দর উপহার হাতে নিয়ে।
সুন্দর মসৃণ পথে মাঝেমাঝেই লেখা সুন্দর বোর্ড বলে দিচ্ছে সে আসছে। সে আবার কে? আরে যেখানে আমরা যাচ্ছি। আর্নেস্ট টিমুথি ম্যাকলুস্কির নাম অনুসারে এখানকার নাম ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ হয়। এই অঞ্চল একসময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের উপনিবেশ ছিল। তবে এখন শুধু পড়ে আছে সেই স্মৃতি আর তাদের পরিত্যক্ত কিছু বাংলো আর বাড়ি। সেগুলোর দুটো একটা হোটেলও হয়ে গেছে। এছাড়াও পশ্চিমের জল হাওয়ার আকর্ষণে বাঙালী বারবারই সেখানে গেছেন তাই অনেকগুলো পুরোনো বাড়িও রয়েছে তারমধ্যে আমরা অপর্ণা সেনের বাড়িটা দেখলাম গেটটা একটু ফাঁক করে। শাল মহুয়া গাছের ছায়ায় আদুরে মসৃণ পথ বেয়ে যেতে যেতে বারবারই মন হারিয়ে যাচ্ছিলো জঙ্গলের নেশায়। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল সর্বধর্ম সম্মেলন ক্ষেত্রে। এখানে হিন্দু মন্দির,গুরুদ্বার,মসজিদ এবং একটা অসম্পূর্ণ চার্চ আছে। চারপাশে পলাশ গাছ দিয়ে ঘেরা বেশ অনেকটা জায়গা। দেখে বুঝলাম মন্দিরে পুজো হয়। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম গাড়িতে তারপর একটু বাদেই গাড়ি নামলো শালবনের মধ্যে। চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা আর পাখির ডাক,কেমন যেন একটা মায়াময় পরশ প্রকৃতির তারমধ্যেই দেখতে পেলাম আমাদের রিসর্টে ঢোকার গেট। চারদিকে সুন্দর গাছপালা আর শালবনের মধ্যে প্রকৃতির কোলে একটুকরো শীতল আবাস। কলকাতা থেকেই বুক করে যাওয়া হয়েছিল এই রিসর্ট অবশ্য এটাকে কটেজই বলা উচিত কারণ নামটাই রানাস কান্ট্রি কটেজ। এই অঞ্চলে রানার অনেক অবদান আছে তার মধ্যে একটা এটাও। আমাদের দলে মোট ছয়জন, সবাই আমার পরিচিত তবে তারা বেশি নিকট আমার বরের। সবাই ওরা একসাথে মর্ণিংওয়াক করে,বয়েসে অসম হলেও মোটামুটি সম মানসিকতা সম্পন্ন। হোলির মরসুমে ওদের ঘর ছিল না বলে আমরা একটা ডর্মিটারী নিয়েছিলাম,ঘর এবং বিছানা সবই বেশ ভালো ছিল। আর তার সাথে ছিল একটা চমৎকার বারান্দা যেখানে বসে আড্ডা জমে উঠত দারুণ। সত্যি কথা বললে ফ্ল্যাটে বন্দি আমি এখনও ভীষণ নস্টালজিক হয়ে পড়ছি যখনই বারান্দাটা মনে পড়ছে। বারান্দায় বসে মন ভেসে যেত আমের মুকুল আর শালফুলের সুবাসে। তার সাথে ছিল পাখিদের কিচিরমিচির ডাক। বাথরুম নিয়েই সমস্যা হয়,এক্ষেত্রে সেটা ছিল না। তিনটে বাথরুম তারমধ্যে দুটো ঘরের ভেতরে আর একটা বাইরে। হোটেলে এসে জিনিসপত্র রেখেই একটু চা খেয়ে আমরা মেতে উঠলাম বসন্তের আমেজে। দেখলাম বয়েস হলেও প্রত্যেকেই মানসিক দিক দিয়ে তারুণ্যের ভরপুর। সুতরাং সেই লম্বা বারান্দায় আমরা সাজিয়ে বসলাম রঙের সম্ভার নিয়ে। বারান্দার উল্টোদিকের আমগাছটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল,কটেজ ভর্তি আম,কাঁঠাল, ফুল আর ফলের গাছ। দেখে অবাক হয়েছিলাম মাটিতে পাকা বেল পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে,কী মিষ্টি সে স্বাদ! অথচ সেই বেল কেউ খাচ্ছে না। আমাদের এক দিদি গোটা কয়েক পাকা বেল কুড়িয়ে আনলেন। আমরাও সবাই হোলি হ্যায় বলে সাজো সাজো রবে আবীরের থালা সাজিয়ে মেতে উঠলাম রঙের উৎসবে। তারপর একটা সময় পরে সবাই ভূত সেজে বসলাম আড্ডা দিতে সাথে অবশ্যই বসন্তের গান। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা ওখানেই ছিল। সুতরাং স্নান সেরে খাওয়ার পালা এখানে যে স্টাফরা কাজ করে তারা বেশিরভাগ এই অঞ্চলেই থাকে। ওরাও কাজের ফাঁকে একে অপরকে রাঙিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার রঙে। আমাদের সাথের এক দাদার আবদার ছিল মাছ চিকেন দুটোই খাওয়া হবে সুতরাং তেমনি অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। বেশ কিছুটা অপেক্ষার পর খাবার পেলাম, রান্না খুব একটা ভালো নয় তবে মাছের স্বাদ খুবই ভালো।
সারা রাতের ক্লান্তি সুতরাং ফের কথার খেলাপ,বিছানায় গড়াতে গিয়ে কুলারের হাওয়া খেয়ে সবাই ডুব দিলাম গাঢ় ঘুমে।
যথারীতি বেরোতে দেরি হয়ে গেল,সুতরাং ছুটে ছুটে তৈরি হয়ে প্রথমেই গেলাম স্টেশনে। ছোট্টখাট্টো ছিমছাম স্টেশন দেখেই মন জুড়োয় এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায়। পলাশ গাছের সারি ঘেরা একটা নিরিবিলি স্টেশন মাঝেমধ্যে একটা দুটো কয়লা ভরা মালগাড়ি চলে যাচ্ছে আপন ছন্দে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে। তারপর আবার ডুবে যাওয়া পলাশের রঙ মাখা প্রকৃতি আর পাখির ডাকে। রেললাইনের পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু সময়। মন চাইলো গাছের ছায়ায় একটা কাঠের বেঞ্চে বসে চুপচাপ নিজের মধ্যে ডুবে যেতে কিন্তু সময় নেই। বাকিরা তাড়া দিলেন,'চলো সূর্যাস্ত দেখতে হবে। আমরা এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি।' কিছু ছেলেপুলে তখনও হোলি খেলছে,দোকান থেকে ভেসে আসছে তেলেভাজার গন্ধ। স্টেশনের পথ পেরিয়ে আসার সময় বারবারই চোখ টানছিল সারি বাঁধা পলাশ গাছ। তবুও এগিয়ে যেতেই হবে, শালগাছের জঙ্গলে ঢুকলো গাড়ি ড্রাইভার বললো অপর্ণা সেনের বাড়ি। দেখলাম গেটে মরচে ধরেছে ঠ্যালা দিতেই ক্যাঁচ করে আওয়াজ হল। ভেতরে ছড়ানো শুকনো পাতা আর তারমধ্যেই জেগে রয়েছে বাড়িটা যা এখন হাতবদল হয়ে গেছে। ভেতরের অবস্থা দেখে আর ঢুকতে ইচ্ছে করল না। একটু উঁকি দিয়ে দেখেই এগিয়ে চললাম সূর্যাস্ত দেখতে।
একটা ব্রীজের ওপর উঠে দাঁড়ালো গাড়িটা নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে দামোদর নদী। যদিও মাঝেমধ্যে জল বাকিটাতে চর পড়েছে,তবে বর্ষার সময় এই নদী হয় বাঁধনহারা স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গ্ৰামগঞ্জ। ব্রীজের ওপর থেকে চোখ মেলে তাকালে সোজাসুজি চোখ গিয়ে পড়ে আকাশে। আর অপূর্ব তখন আকাশের রঙ,বিদায়ী সূর্য তাঁর রথে চেপে অস্তাচলের পথে তারই ছটায় তখন আকাশে চলছে রঙের হোলি। এদিকে আবার উঁকি দিয়েছে পূর্ণমার চাঁদও। দামোদরের চারপাশে অসংখ্য পলাশের গাছ তাই পৃথিবীও রঙ ছড়িয়েছে আকাশের সাথে। সব মিলে মনে তখন এক স্বর্গীয় অনুভূতি,হয়ত বা দোলপূর্ণিমার এক গোধূলি বেলায় দেখা সূর্যাস্তের রঙ মনের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে থাকবে আজীবন।
সূর্য অস্ত গেলো কিন্তু রঙের রেশটুকু প্রকৃতিতে আর আমাদের মনে রয়ে গেল। টুংটাং ঘন্টি বাজিয়ে ঘরে ফিরছে গরুর দল,গোধূলির শোভায় মনকে রাঙিয়ে আমরাও ফিরলাম আমাদের আস্তানায়। এখানে জমাটি আড্ডা দেওয়ার জায়গার অভাব নেই। পূর্ণিমার চাঁদের ছটা তখন আকাশে,বেশ গরম ঘন আমেজ আনা দুধ চা আর সাথে টা মানে পকোড়ার প্লেট নিয়ে শুরু হল আমাদের আড্ডা। আমাদের সাথে এক দাদা ছিলেন তিনি যেমন মজার কথা বলেন তেমন গুণী মানুষ। আমার কাছে তো তিনি বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ। তাঁর কথা বলার ধরণ এত সুন্দর যে হাসির গল্প শুনলে হা হা করে হাসতে হয় অনেক সময়। আমি তো গল্পগুলো মনে করে পরেও একা একা বসে হেসেছি। বয়েস তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি তারুণ্যে তিনি ভরপুর। আরেক দাদার দায়িত্ব ছিল আমাদের খাবারদাবারের জোগান দেবার। তার ঝুলি থেকে সবসময়ই বেরিয়ে আসছে এটা সেটা সুতরাং আর কী চাই?
সেদিন রাতের খাবার একদমই ভালো ছিল না,বুঝলাম রঙের নেশা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে রাঁধুনীকেও। রান্নাতে তার মোটেই মন ছিল না। পরদিন আমাদের খুব সকালে বেরোনো ছিল না তাই খাওয়া শেষে বারান্দায় বসে একটু জমাটি আড্ডা দিয়ে এবং রেশটুকু ঘরে নিয়ে এসে যে যার বিছানায় এলাম। তবে সেখানেও জমে উঠলো হাসির মেলা। হয়ত বা এক ঘরে থাকার এটাও একটা সুখ। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা প্রাইভেসি প্রেমিক নই,বিশেষতঃ এই বয়েসে এসে আর কী এসে যায়?
ছজন একঘরে সুতরাং অ্যালার্মের প্রয়োজন নেই,সকালেও হাসির দমকে ঘুম ভাঙলো। আরেক দাদার নাকি হাত ব্যথায় ঘুম আসছিল না,তাকে তার গিন্নী থাপড়ে থুপড়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমাদের সিনিয়ার দাদার রসিকতাতে তা অন্য মাত্রা পেল। ' স্বপন রাতে কান্নাকাটি করছিল,মলি না না কাঁদে না বলে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ঐ দাদা একটু আদুরে,এক সময় মায়ের আদরে মানুষ হয়েছেন এখন বৌয়ের। মাছের কাঁটা বেছেও খাইয়ে দেয় বৌ দরকারে। তিনটে বাথরুম সুতরাং কোন অসুবিধা নেই,চটজলদি সবাই রেডি হয়ে নিলাম। আমাদের গন্তব্য মা ছিন্নমস্তার মন্দির আর পাত্রাতু ভ্যালি। আমাদের দলের কেউই তেমনভাবে আর উপোস করতে পারি না তাছাড়া মায়ের কাছে যাব সুতরাং খেয়ে যাওয়াই ভালো।
বাইরের আবহাওয়া খুব ভালো ছিল ভোরবেলায় আর সন্ধ্যেতে,বেশ একটা শীত শীত ভাব। শাল গাছগুলো সবে সকালের আলো মেখেছে। বেশ কিছুটা পথ যাবার পর ড্রাইভার আমাদের একটা দোকানে নিয়ে এল। দেখলাম গরম গরম লুচি ভাজা হচ্ছে। আমরা লুচি খাব না তাই কেউ কেউ ইডলি আর কেউ ধোসা নিলাম। দোকানটা পুরোনো হলেও খাবার বেশ ভালো। ঢোকার মুখেই চোখ আটকে গেছিল রসগোল্লার সাইজে। সুতরাং একবার চেখে দেখতেই হবে সেটা। বিরাট সাইজের রসগোল্লা এল,তবে একটু ভয়ে ছিলাম স্বাদ কেমন হবে? কিটকিটে মিষ্টি নয় তো? কামড় দিতেই জাস্ট ফিদা হয়ে গেলাম। উঃ এতো চরম খেতে! হাল্কা পাতলা রসে টইটুম্বুর ফুলোফুলো নরম তুলো,কামড় দিয়ে শেষ করার আগেই মন বলে দিল মাঙ্গে মোর। সুতরাং আরেকটা চাই,উপলব্ধি করলাম জীবনের চরম সত্য যে আমরা খাওয়ার জন্য বাঁচি। তবে কালাকাঁদটাই আর বাকি থাকে কেন? সেটাও তো খাসা দেখতে ছিল একদম টাটকা থরে থরে ট্রেতে সাজানো। সুতরাং লাও ভাই কালাকাঁদ,সেটাও দারুণ খেতে ছিল। জীবনের রঙ,রস,বর্ণ আর খাদ্য সবই উপভোগ করা উচিত এই আশ্বাসবাণী নিজেকে দিয়ে উদরপূর্তি শেষে বর্ধিত মধ্যপ্রদেশে হাত বুলিয়ে আহ বলে বেরিয়ে এলাম সবাই।
ঝকঝকে হাইওয়ে ধরে গাড়ি চললো এগিয়ে বাইরে তখন বেশ রোদ। অনেকটা পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ছিন্নমস্তা মন্দিরে। আমাদের সহযাত্রী দুএকজন আগে গেলেও আমি এই প্রথম এলাম মায়ের মন্দিরে। তবে মনে সংশয় যদি ভীড় হয়। তবে সব ভয় মুছে দিয়ে মা মন জয় করে নিলেন।
ঝাড়খন্ডের রামগড় জেলায় অবস্থিত রাজারাপ্পা ছিন্নমস্তা মন্দির এক হিন্দু তীর্থস্থান যা তান্ত্রিক শিল্প শৈলীর জন্য বিখ্যাত। এই ছিন্নমস্তা দেবীর মাহাত্ম্যে ছুটে যান অগণিত ভক্ত প্রতিদিন। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গল্প ছিন্নমস্তার অভিশাপ অনেকেই পড়েছেন। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম মায়ের দর্শনে সেদিন শনিবার ছিল তাই মনে কিছুটা চিন্তা ছিল মায়ের দেখা পাবো কিনা এই নিয়ে,তবে মা সত্যি অন্তর্যামী তাই দেখলাম অতি সহজেই মায়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। মন্দিরের প্রবেশপথ খুব সুন্দর এখন মন্দিরও সুন্দর করে রং করা হয়েছে তবে মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। গর্ভগৃহ বেশ শুকনো এবং পরিস্কার ভিতরে যাতে একসাথে ভিড় না হয় সেজন্য একসাথে অনেককে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সুন্দর মায়ের মূর্তি দেখে মন ভরে গেলো। পুরোহিত খুব সুন্দর করে পুজো করিয়ে দিচ্ছেন আমরাও মাকে প্রণাম করে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বেরোলাম প্রসন্ন চিত্তে। মায়ের মন্দিরে ঢোকার মুখে আছে বাম হাতে শিব মন্দির সেই শিবলিঙ্গের উচ্চতা দেখার মতই সেদিন দোলের পরদিন ছিল তাই মোটামুটি ফাঁকা ছিল মন্দির। মায়ের দর্শন শেষে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে পৌঁছে গেলাম নদীর ধারে সেখানে পূজা সামগ্রী আর মোরাদাবাদী চুড়ির দোকান। এই মন্দিরে তান্ত্রিক মতে পূজা হয় তাই অনেক বলি হয় রাজারাপ্পা ছিন্নমস্তা মন্দিরে। বলি দেখতে পারি না তাই হয়ত মায়ের ইচ্ছাতে সেই দৃশ্য দেখতে হয়নি। তবে দেখলাম নদীর ধারের পাথরে বসে সেই বলির প্রসাদের চামড়া পরিস্কার করা হচ্ছে। দামোদর আর ভৈরবী নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই মন্দির খুবই সুন্দর। তবে যদি যদি আরেকটু পরিস্কার হত নদীটা তবে খুব ভালো লাগত। তবে নদীর মাঝে মাঝে জেগে আছে পাথর এবং জলও খুব স্বচ্ছ ।নদীর ধার বরাবর চোখ যতদূর গেল দেখলাম দুপাশে পলাশের রঙে রঙিন ফাগুন। হাতে সময় কম বলে কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে শরীর মন শীতল করে আমরা এগিয়ে গেলাম পরবর্তী গন্তব্যে। একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো যে কোনো পান্ডার অত্যাচার নেই আর মন্দির প্রাঙ্গন একদম শুকনো আর পরিস্কার।
মায়ের মন্দির দেখে বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচন্ড গরম। সহযাত্রী দিদি তাড়াতাড়ি করে ঠান্ডা ফ্রুটি কিনে আনলেন,একটু শীতল হল মন প্রাণ। এগিয়ে চলা পাত্রাতু ভ্যালির দিকে। পাত্রাতু এক পাতা ঝরার উপত্যকা বলে আমার মনে হল। জানলা দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম হাওয়ায় ভেসে ভেসে ঝরা পাতারা ঘুরে ঘুরে মাটিতে এসে পড়ছে। সোজা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি, আর পাতারা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে। সে এক সুন্দর যাত্রাপথ যেন ঝরে পড়ার বেলায়,গাছের সমস্ত বন্ধন কাটিয়ে আনন্দে ভেসে যাওয়া বাতাসে তারপর একটা সময় মাটিতে পড়ে থাকতে মাটিতে মিশে যাওয়া। মানুষের জীবনের জন্ম মৃত্যু চক্রের মতই সমস্ত বন্ধন কাটিয়ে বাতাসে ভেসে যাওয়া আত্মার। আঁকাবাঁকা পাতাঘেরা পথে সাজানো ভ্যালি। পথের সীমান্তে দাঁড়ালে চোখ চলে যায় নীচ পর্যন্ত। ভ্যালি দেখে আমরা এলাম ড্যামে,তবে ড্যামে প্রবেশের দরজা বন্ধ সেদিন হোলির জন্য। হতাশ হয়ে পাশের হোটেলের গেটে ঢুকলাম,একদম লেকের গায়েই হোটেল। বাঁধানো পথ বেয়ে চলে গেলাম পাত্রাতু লেকের ধারে,বাইরে তখন কাঠফাটা রোদ। লেকের শোভা কিন্তু খুব সুন্দর। পাহাড়ের কোলে অনেকটা গভীর লেক। এবার কিন্তু সবার খিদে পেয়েছে সুতরাং ড্রাইভারকে বলা হল খাবারের জায়গা দেখতে,কিন্তু হোলির জন্য সবই দেখলাম বন্ধ। খোঁজ করতে করতে আবার চোখে পড়ল পথের নীচেই লেক,তার ধারে পলাশ গাছ। অনেকেই নৌকো চড়ে ঘুরছে লেকে। আমরাও নীচে নেমে নৌকো না চড়ে শুধু লেকের শোভা আর পলাশ দেখেই ফিরে এলাম।
ড্রাইভার মরিয়া হয়ে খুঁজে কোন খাবার আস্তানা না পেয়ে বললো,' মালুম হোতা হ্যায় রাঁচি যানা পড়েগা।' অবশেষে রাঁচিতে এসে মেন রাস্তা থেকে বাঁদিকে ঢুকে একটা বাঁশের বাড়ির উঠোনে এসে ঢুকলো,বুঝলাম এটাই খাবার জায়গা। আগে নিজে খোঁজ নিয়ে এসে বললো আপলোগ যাইয়ে মিলেগা খানা। উঠোনে বেশ কয়েকটা হৃষ্টপুষ্ট মোরগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা জুতো খুলে ভেতরে এলাম। অন্দরের সাজ একদমই অন্যরকম। বেশ একটা ট্র্যাডিশনাল লুক রয়েছে ভেতরে। আছে ধামসা আর মাদলও। রেস্তোরাঁর নাম আজম এম্বা শুনলাম ঝাড়খণ্ডের আঞ্চলিক কুরুক ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অপূর্ব। ভেতরে অনেকগুলো বসার জায়গা আছে। ওরা আমাদের যত্ন করে মাটির ঘরের ভেতরে বসালো। হোটের হোস্টেস একটা মেয়ে সে আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করল আমরা কী খেতে চাই? সামনেই হাতে লেখা মেনু ছিল,তাছাড়াও আমরা জানতে চাইলাম এখানকার সিগনেচার ডিশ কী? ও বলল এখানে মাংস ভাত সবাই খায়,মানে মাটন থালি। তার সাথে আমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করল ধুসকা খেতে। ধুসকা এখানকার ট্র্যাডিশনাল ডিস।
একটু বাদেই ধুসকা এসে গেল শালপাতাতে করে। তার সাথে থানকুনি পাতা আর ব্রাম্ভী শাক দিয়ে একটা অদ্ভুত চাটনি আর আলু ছোলার তরকারি। ধুসকা কিন্তু দারুণ খেতে বললো কলাইয়ের ডাল,চানা ডালা আর চাল মিশিয়ে ভিজিয়ে রাখে রাতে। তারপর ওটাকে বেটে একটু ফার্মেন্টেশনের জন্য রেখে দেওয়া হয়। জিনিসটা ফুলে উঠলে তারপর তাকে পোয়ার আকারে ছাকা তেলে ভেজে নেওয়া। খিদের পেটে খুবই সুস্বাদু আর মুখরোচক লাগলো ধুসকা।
ধুসকা খাওয়ার কিছুটা বাদেই শালপাতাতে এল গরম গরম মাংস ভাত,চাটনি আর স্যালাড সাথে কাঁচালঙ্কা আর লেবু। পরিবেশন এত সুন্দর ছিল যে মন ভরে গেল। ঠিক মনে হল কোন এক গ্ৰামের মাটির বাড়িতে বসে শালপাতার থালা আর পেতলের গ্লাসে খাবার খাচ্ছি। আগেই বলেছিল রেড রাইস আর তার সাথে লোকাল গোটের মিট দেবে। ভাতের স্বাদ যে কী ভালো ছিল বলে বোঝাতে পারব না। আমার ছোটবেলায় দিদার বাড়িতে এমন জমির চাল আসত,একটু লাল চাল কিন্তু খুব মিষ্টি। দিদা সেই চালের ফ্যানা ভাত করত,আমার মুখে এখনও সেই স্বাদ লেগে আছে। দিদারা দুই জা একই রান্না ঘরের দুই পাশে রাঁধত আমার মামারা মানে মায়ের খুড়তুতো ভাইয়েরা আবার সেই ভাতে গুড় দিয়ে কখনও আম দিয়ে মেখে খেত। আমি অবাক হতাম দেখে,তবে আমি ফ্যানা ভাতে আলুসেদ্ধ দিয়ে খেতে খুব ভালোবাসতাম। অনেকদিন বাদে ছোটবেলায় খাওয়া সেই লাল চালের ভাতের কথা খুব মনে হল। গরম ভাতে তুলতুলে নরম মাংসের কাঁচালঙ্কার সবুজ ঝোল মাখিয়ে খেতে খেতে ডুবে গেছিলাম অদ্ভুত এক ভালোলাগায়। মন শুধু বলেছিল আহা আহা,আর তারপর যখন একটু করে চাটনি টাকরায় ঠেকাচ্ছি তখন তো পুরো জিভে জল। সত্যি চাটনিটা অদ্ভুতরকমের ফাটাফাটি ছিল খেতে। খেয়েদেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আমরা বেরোলাম,ওখানে মাটন ভাত মোটামুটি তিনশো টাকার মত দাম ছিল। তবে যেহেতু হোলির দিন কোন ভিড় ছিল না আমরা বাড়ির মত নিজেরাই পুরো দখলদারি করে সময় কাটালাম ইচ্ছেমত।
সেদিনের মত আমাদের ঘোরাঘুরি প্রায় শেষের পথে তাই আবার ফেরা ম্যাকক্লাসকিগঞ্জ। সবাই উদরপূর্তির পর পরিতৃপ্ত আর ক্লান্ত। ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এল সীতাকুন্ডে,একটা কুন্ড মত দেখলাম তবে এর ইতিহাস আমার জানা নেই। ড্রাইভারও কিছু বলতে পারল না। হয়ত মিথিলা কন্যা কখনও এই কুন্ডে অবগাহন করেছেন সেটাই ভেবে নিলাম। স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি এল ডোগাডুগি নদীর কাছে। দাদা দিদিরা কেউই নামতে চাইলেন না। তবে আমি মুগ্ধ হলাম সেই জায়গার নিস্তব্ধতা আর সৌন্দর্যে। ছোট্ট পাহাড়ের মাঝে নদী,পাথরের খাঁজে আকাশ থেকে উড়ে ঘুপ করে ঢুকে যাচ্ছে চাতক পাখির দল। আমি অবশ্য চাতক পাখি চিনি না আমাদের সাথে যে দিদি ছিলেন তিনিই বললেন ওগুলো চাতক পাখি। নদীর কোথাও চর পড়েছে তবে পাথরের মাঝে যতটা জল আছে সেটা খুব গভীর আর আকাশের নীল রঙ ধার নিয়ে গাঢ় নীল। সেই নীল জলে পড়েছে পাশের সবুজ গাছগাছালির ছায়া। বড় মন ভোলানো জায়গাটা,এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যায় বা এখানে বসে সত্যিই লিখে ফেলা যায় আস্ত একটা কবিতা। তবে আমার সেই সুযোগ ছিল না তাই একটা দুটো ছবি তুলে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সবাই মোটামুটি ভাজাভাজা তখন,তাই একটু বিশ্রাম নিলাম।
সেদিনের সন্ধ্যেটাও ছিল জমজমাট লম্বা বারান্দায় বসে আড্ডায়। আমাদের দাদার ঝুলি থেকে বেরোতে লাগলো নানা মজাদার গল্প। সবাই হেসে উঠলাম আনন্দে। পরের দিন আমাদের বেতলা যাওয়া,বেতলা দেখে একদম চলে যাব নেতারহাট। বেতলা যেতে হলে ভোর পাঁচটা নাগাদ বেরোলে ভালো হয় তা ড্রাইভার বলে গেল। সুতরাং একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া হল রাতে। ভোরে উঠতে একটু কষ্ট হলেও ভোরবেলা বোধহয় দিনের সবচেয়ে সেরা সময়। তাই দরজা খুলে বাইরে এসে আমাদেরও মন ভালো হয়ে গেল,বাইরে তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি একটু হাল্কা ঠান্ডার আমেজ ছড়ানো প্রকৃতিতে। পাখিদের কিচিরমিচির বলছে একটু বাদেই আলো ফুটবে। শাল গাছের জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের গাড়ি উঠে এল রাস্তায়,সবে আলো ফুটেছে খোলা জানলা দিয়ে আসা টাটকা তাজা ভোরের হাওয়া মন ভরিয়ে দিল তার সাথে দাদা চালিয়ে দিলেন ভক্তিমূলক ভজন। বেশ মন ছুঁয়ে গেল সেদিনের ভোরবেলা। এখানে রঙের উৎসব আছে সেদিনও তাই প্রকৃতির রঙে মনকে রাঙিয়ে আমরা ছুটে চললাম বেতলার দিকে। বেতলা মোটামুটি ছিয়ানব্বই কিমি দূরে সুতরাং উঁচু নীচু পাহাড়ি পথ আর জঙ্গলকে পাশে রেখে বেশ অনেকটা যাবার পর এল কেচকি। এই কেচকির প্রতি আকর্ষণ ছিল আমার কর্তামশাইয়ের কারণ এখানেই হয়েছিল অরণ্যের দিনরাত্রি ছায়াছবির শুটিং। আমরা কেচকিতে ঢোকার আগে লেবেল ক্রশিং পড়ল,ট্রেন যাবে বলে সেটা বন্ধ ছিল। সুতরাং গাড়ি ওখানেই থেমে রইল। আমরা রেললাইন পেরিয়ে গুমটি পেরিয়ে গেলাম ওপারে। ছোট্ট রেলগুমটি খানা আমার খুব ভালো লাগলো। কেন যেন ছোটবেলায় হঠাৎই ফিরে গেলাম। জঙ্গল এখানকার তেমন আকর্ষণীয় লাগল না আমার,আমাদের দুএকজন গেল কোয়েলের কাছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম পাখির ডাক।
আমাদের বেতলা যেতে হবে,যে কোন জঙ্গলে যাবার উপযুক্ত সময় ভোরবেলা আর বিকেলের পর কারণ তখনই পশুরা বেরোয় জল খেতে। তবে আমরা যেহেতু বেশ দূরে ছিলাম বেতলা থেকে তাই পৌঁছতে দেরিই হয়ে গেল। বেতলা ন্যাশনাল পার্কে থাকার জায়গা আছে,সেখানে থাকলেই সম্ভব একটু সকালে ন্যাশনাল পার্কে ঢোকা। আমরা টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটলাম একজন গাইডও নিতে হল সঙ্গে। জঙ্গলে ঢোকার জন্য আলাদা গাড়ি,তবে সেটা খোলা গাড়ি ছিল না জানলা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই। বেশ কিছুটা সময় জঙ্গলে সাফারি করে দেখলাম প্রচুর হরিণ,ময়ূর,বন্য শূকর একখানা,বাঁদর,হনুমান আর পাখি। হাতির পায়ের ছাপ দেখলাম তবে দেখা পেলাম না। আমাদের গাইড কিছু সময় বকবক করে পেছনে বসে ঘুমোলো,ষোলোশো গেল। যাক জঙ্গলে ঘুরে প্রকৃতিকে দেখলাম কিন্তু মন ভরল না তেমন।
সকালে আমাদের পেটে কিছু পড়েনি তাই খেতে ঢুকলাম বেতলার গেট লাগোয়া ক্যাফেতে। খুবই ধীর গতিতে আমাদের টেবিলে এল আলু পরোটা আর অমলেট সাথে টকদই। খেয়েদেয়ে গাড়ি ছুটতে লাগলো,আমরাও ডুব দিলাম প্রকৃতি দর্শনে। সোনালী পাতার সারিবদ্ধ গাছেরা আমাকে মুগ্ধ করল তাদের রূপে। বুঝলাম ঝরাপাতারও অপরূপ রূপ,প্রকৃতি জীবনের মতই তাই প্রতি ঋতুতেই তার অনন্য রূপ।
আমরা যাচ্ছি নেতারহাটের পথে,এই পথে তিনটে সুন্দর ঝর্ণা পড়ে। আমরা প্রথমে গেলাম মিরচাইয়া ফলসে,এখন ঝর্ণাতে তেমন জল নেই। তবে প্রতিটা ঝর্ণাতে যাবার পথ খুব সুন্দর করে বাঁধানো। আমরাও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালাম,খুব ইচ্ছে হল একবার বর্ষায় এই পথে যাবার। না জানি তখন কী অপূর্ব রূপ হবে প্রকৃতির। মিরচাইয়া দেখে আমরা এলাম সুগা বান্ধ ওয়াটার ফলসে। এই ঝর্ণাগুলো এইজন্যই ভালো যে এগুলো দেখার জন্য খুব সিঁড়ি ভাঙতে হয় না। আমার কিন্তু মিরচাইয়া ফলসের জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। সব শেষে এলাম লোধ ওয়াটার ফলে,এখানে ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হলে এক থেকে দেড় কিমি হাঁটতে হয়। তবে ঝর্ণাকে দেখা যায় দূর থেকে,আর আওয়াজও শোনা যায়। সেদিনও পথে খাবারের দোকান পেতে খুব অসুবিধা হল,অবশেষে প্রায় বিকেলের দিকে নেতারহাটের কাছাকাছি এসে ড্রাইভারের এক বন্ধুর দোকানে খাওয়া হল। নেতারহাটে ঢোকার রাস্তা ভীষণ সুন্দর একদিকে পাইনের গাছ আরেকদিকে শালের বন। পাহাড়ের ওপর কিছুটা উঠেছি বলে প্রকৃতিও বেশ শীতলতায় মোড়ানো। শুধু মনে হয় জানলা দিয়ে মুখ বের করে সেই ঝাপটা মাখি মুখে চোখে। নেতারহাট বেশ বিদেশী ঢঙে সাজানো,হঠাৎই মনে হল বিদেশের কোন ছোটখাটো জায়গায় এসে পড়েছি।
আমাদের সেদিন সূর্যাস্ত দেখার কথা ছিল,নেতারহাট থেকে সানরাইজ এবং সানসেট খুবই ভালো দেখা যায়। তবে মেঘলা আবহাওয়ার জন্য সূয্যি মামা চুপটি করে ডুব দিলেন মেঘের আড়ালে ঝুপ করে। আমরাও ফিরে এলাম নাশপাতি বাগানকে পাশে রেখে আমাদের হোটেলের দিকে। নেতারহাটে নাশপাতি বাগান আছে,তখন নাশপাতির সময় নয় বলে গাছ ফাঁকা ছিল। আমাদের হোটেল খুবই সাধারণ মানের ছিল। ওখান থেকে একটু এগিয়ে ঝাড়খন্ড টুরিজমের হোটেল প্রভাত বিহার খুবই সুন্দর লোকেশনে অবস্থিত তবে আমরা সেখানে বুকিং পাইনি। আমাদের ম্যাকক্লাসকিগঞ্জের হোটেল থেকে এখানে এসে মনটা একটু খারাপ হল। তবে দেখলাম এখানে বারান্দা আর একটা বড় উঠোন আছে সেখানে বসে আড্ডা দেওয়া যায় কিন্তু প্রাইভেসি তেমন নেই। তাছাড়া সবার আলাদা ঘর সুতরাং বিছানা বৈঠকীও হবে না। যাইহোক ভাবলাম একটা দিন কোনমতে কাটিয়ে দিলেই তো কালকে চলে যাব। আমাদের হোটেলের নাম ছিল সানরাইজ। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে ঐ একফালি বারান্দাটাতেও বসার সুযোগ মিস্ করলাম না। জমে গেল চায়ের সাথে টায়ের আড্ডা। কিছুটা বাদে দুটো স্কুল বাস এসে একদম হোটেলের উঠোনে। অনেক মানুষজন নেমে এলেন সেখান থেকে তাই মুহূর্তের মধ্যেই জমজমাট হয়ে উঠলো হোটেল। ওনারা এসে আমাদের সাথে আলাপ করলেন শুনলাম লাতেহারের একটা স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাদের পরিবার নিয়ে পরীক্ষা শেষে একটু নিজেদের মত সময় কাটাতে এসেছেন। তারপর ওদের আন্তরিক ব্যবহারে আমরাও ওদের পরিবার হয়ে গেলাম। খুবই ভদ্রভাবে জিঞ্জাসা করলেন যে একটু অনুষ্ঠান করবেন ওরা আমাদের অসুবিধা হবে কিনা? আমাদের দাদাও ওদের সাথে গানে অংশগ্রহণ করলেন। ওদের একান্ত অনুরোধে রাতের বুফে ভেজ ডিনার আমাদের একসাথে করতে হল। একেই বোধহয় বলে পথের সাথী,হঠাৎই দেখা,কথা আর আন্তরিক ভাবে মিলেমিশে যাওয়া।
পরদিন ভোরে উঠে গেলাম প্রভাতবিহারে সূর্যোদয় দেখব বলে,দেখলাম প্রচুর মানুষ ভিড় করেছেন সূর্যোদয় দেখবেন বলে কিন্তু সেদিন মেঘলা থাকায় সূর্য মুখ লুকোলেন মেঘের আড়ালে। যখন উনি দেখা দিলেন তখন বেশ ওপরে উঠে গেছেন। আমাদের সেদিন ফেরার পালা। সুতরাং খুব তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরোলাম। নেতারহাটে একটা সুন্দর বাংলো আছে যার নাম শ্যালেট হাউস Chalet House যেটা লেফটেন্যান্ট গভর্নমেন্ট স্যার এডওয়ার্ড গেটের সময় তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে এই বাংলো গ্ৰীষ্মকালীন অবসর বিনোদন যাপনে এবং গ্ৰাম্য মুখিয়াদের সঙ্গে আলোচনা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। এই বাংলো সুন্দর সাজানো গোছানো এবং প্রতি ঘরে প্রবেশ করা যায়। দোতলায় ওঠা যায় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে এবং বাংলোটাও কাঠের। ভেতরে কিছু ছবি আর পুরোনো ব্যবহৃত জিনিসপত্র আছে তারমধ্যে কিছু জিনিস ঝাড়খন্ডের ট্র্যাডিশনাল। একটা ঢাকা দেওয়া গোপন সিঁড়িও আছে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো একদম সুন্দর সবুজের বুকে সুসজ্জিত শ্যালেট হাউস।
নেতারহাটকে বিদায় দিয়ে ছুটে চলা রাঁচির উদ্দ্যেশ্যে,সোনালী গাছের সারিমাখা পথ আর পাইনের ছায়াঘেরা পথ কিছুক্ষণ বাদে হারিয়ে গেল। এসে পড়লাম গ্ৰামের রাস্তায়,তারপর বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে রাঁচিতে এলাম। রাঁচির ঝরনাগুলোতে এখন জল তেমন নেই তাই সেগুলো দেখব না বলেই ঠিক করেছিলাম আগেই। সুতরাং ঠিক হল রাঁচিতে জগন্নাথ মন্দির এবং সূর্যমন্দির দেখে আমরা স্টেশনে চলে আসব। দুপুরের খাওয়ার জায়গাতে ড্রাইভারই নিয়ে এল। রাস্তার পাশেই হোটেল কিন্তু সেখানে বিরাট আয়োজন প্রচুর লোকজন খাচ্ছে। রাঁচিতে মাটন ভাত খুবই চালু খাবার সুতরাং সবাই দেখলাম তা খেতেই ভিড় করেছে। এখানে মাছ ভাজা আর ঝোলও পাওয়া যায়। আমরা মাছ,মাংস দুটোই খেলাম। স্বাদ ভীষণ ভালো এবং দামও বেশ কম,হোটলের নাম সারানা।
যাত্রাপথের শেষে আবার ঘরে ফেরার পালা,ট্রেন যেহেতু রাতে তাই কয়েক ঘন্টার জন্য রাঁচি রিটায়ারিং রুম বুক করা হয়েছিল। ভীষণ ভালো ঘর বিছানা, বাথরুম সবই,একদম নতুন করে বানানো। সুতরাং শুরুতে একটু হোঁচট খেলেও শেষে এসে ভালোই কাটলো সব কিছু। একটা ছোট্ট ছুটির শেষে ঘরে ফেরা কিছুটা অক্সিজেন নিয়ে।
Comments
Post a Comment