ফোনটা খুলতেই একটা ছোট্ট নোট পায় রাজ,একটু অবাক হয় এত সকালে মা আবার কী মেসেজ করল? ঘুম থেকে উঠেই তো মাকে না দেখলে ওর দিনই শুরু হয় না। কখন কী খাবে? কোথায় ওর জিনিসপত্র সবই মা হাতের কাছে গুছিয়ে দেয় বরাবরই। সেখানে একটা ছোট্ট নোটস লেখা,' বাবু আজ একটু ম্যানেজ করে নে আমি একটু দরকারে বেরোলাম। চাবি আমার কাছে আছে।'
কী জানি কোথায় এমন দরকার পড়ল যে সাতসকালে মাকে বেরোতে হল। এখন কে ওকে সকালে গরম জলে লেবুর রস দেবে? তারপর আমন্ডের খোসা ছাড়িয়ে,ওয়ালনাট ভেজানো হাতের কাছে ধরবে?
মনটা একটু তেঁতো হয়ে গেলেও নিজেকে সামলায় রাজ। মায়ের কথা মনে পড়ল আবার..' বড়ো হবি না নাকি কখনও? আমি কী চিরকাল থাকব? সবসময় খালি মা আর মা। এত বড় ছেলেকে সব গুছিয়ে দিতে হয়। ওহ্ আর পারি না বাপু। তোর কাজ সারাদিন সারতে সারতে আমি হাঁপিয়ে উঠি। ঘরটার কী অবস্থা করে যাস খেয়াল আছে? আর কত জ্বালাবি আমাকে? ভুলে যাস বোধহয় আমিও একটা মানুষ।'
মায়ের রাগ হয়েছে বুঝতে পারে রাজ,অবশ্য এমন রাগ মাঝেমধ্যেই মায়ের হয়। তখন একপ্রস্থ চ্যাঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে। ছোটবেলা থেকেই এমন দেখে এসেছে মাকে। তখন মা রাগ করে বকলে ওর কান্না পেত,চোখে জল আসত। কাঁদলে মা বকত,' ছেলেদের কাঁদতে নেই বলেছি না। একদম কাঁদবি না, অন্যায় করেছিস তাই বকছি। তুই কী একটুও আমাকে বুঝবি না?' এভাবেই দুজনে দুজনকে বুঝেই আর দুজনের মুড সামলে কেটে গেছে এতগুলো বছর।
এখন মাকে আরেকটু বেশি খামখেয়ালি লাগে ওর। গুগল থেকে জেনেছে কিসব হরমোন টরমোনের ব্যাপার এসব। মায়ের মাঝেমধ্যেই মুডসুইং হয়। কখনও ওকে বকতে বকতে ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। তখন ওকেই স্বান্তনা দিতে হয়। মা বাচ্চাদের মত বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদে,' আমার সারা জীবনটা এভাবেই কেটে গেল। তোরা কেউ আমাকে বুঝিসনা। কখনও আমার কথা ভাবিস না। ঐ একটা মানুষ আমার ঘাড়ে তোকে চাপিয়ে চলে গেল আর তারপর থেকে চলছে...'
এই কথা কতবার যে মায়ের মুখে শুনেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ছোটবেলায় চুপ করে শুনেছে,কখনও ঐ একটা মানুষের অপদার্থ ছেলে হওয়ার অপরাধে বা ঐ বদমাশ লোকটার মতই হওয়ার জন্য মায়ের যত রাগ পড়েছে ওর ওপরে। চুপ করে মারধোরও হজম করেছে কখনও। অথচ ঐ বদমায়েশ লোকটার প্রেমে পড়ে মা ভুলেছিল সমাজ,সংসার এমনকি ভুলেছিল মা বাবাকেও। তারপর ভালোবাসা ফিকে হয়েছিল একটা সময় মা বুঝতে পেরেছিল ভুল আর তবে ঐ ভুলের মাশুল হিসেবে আমি নামক অপদার্থ তততক্ষণে পৃথিবীতে চলে এসেছি। তারপর যা হয়,আমি ঐ বদমাইশ লোকটার দান হলেও মা ঘর ছাড়লেও ছাড়তে পারেনি আমাকে। ট্যাকে বেঁধে ছেলে নামক আবর্জনাটাকে তুলে নিয়ে এসেছিল কয়েক বছরের সংসারাবাস থেকে। মায়ের চিৎকার বকাঝকাতে কোন সময় নিজেকে সেটাই মনে হত ওর। একদিন বলেও ফেলেছিল সে কথা..' সবসময় এত বকা,মার না দিয়ে আমাকে মেরে ফেল মা তোমরা। আমি বেঁচে যাই। তোমরা সবসময় তোমাদের দুঃখের কথা ভেবেছো। কখনও কী ভাবো আমাকে কী যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়? তোমাদের ইগো,তোমাদের সমস্যা,ঝগড়া আর আমার বদমাইশ বাবা আমার জীবনটা নরক করে দিয়েছে। সবাই কী সুন্দর মা,বাবার সাথে থাকে। আমাকে বন্ধুদের কাছে,স্কুলে কত কী শুনতে হয়। আমাকে মেরে ফেলো মা।'
কথাগুলো বলে কাঁপছিল রাজ উত্তেজনায়। আরও কিছু চড় থাপ্পড় জুটেছিল কপালে সত্যি কথাগুলো বলার জন্য। ওর মরে যাওয়ার কথায় খুবই কষ্ট পেয়েছিল মা। অনেক কেঁদেছিল।
তারপর রাগ কমে গেলে মা আবার নিজেও প্রচুর কান্নাকাটি করে জড়িয়ে ধরে বুকে আদর করেছে। তখন অভিমানে ওর চোখ ভরেছে,কিন্তু আর কিছু বলেনি।
রাজের মা অনু সেই ঘটনার পর থেকে একটু চুপ করে গেছিল। হঠাৎই বুঝেছিল ছেলে বড় হয়ে গেছে এখন প্রতিবাদ করতে পারে। আজ মরে যাবার কথা বলে ফেললো কেন এভাবে? তাহলে কী ভেতরে ভেতরে ওর কষ্টের পাহাড় জমছে ওর মতই?
নিজে একটা ছোটখাটো চাকরিও করে অনু,আর বাবার দেওয়া কিছু টাকাতে ওদের চলে যায় মোটামুটি। যদিও টাকাটা ও কিছুতেই নিতে চায়নি তবুও বাবা জোর করে দিয়েছিলেন এই বলে যে এই টাকাটা ওর বিয়ের জন্যই রাখা ছিল। যেহেতু বিয়েতে কোন খরচ হয়নি তাই টাকাটা উনি ওকেই দেবেন। এছাড়া মা কিছু গয়নাও দিয়েছিলেন। সেগুলো নাকি ওর জন্যই রাখা ছিল। সব মিলিয়ে চলে গেছে এতগুলো বছর কখনও টেনেটুনে কখনও ভালো করে। রাজের বাবার মারধোরও খেয়েছে একটা সময় ঐ টাকার জন্যই। তখন যদি বাবার দেওয়া টাকাগুলো ওর হাতে থাকত তাহলে সেগুলোও লুটপাট করত ঐ লোকটা। একটুও ছিটেফোঁটা সহানুভূতিও জাগে না আর আজকাল লোকটার ওপর। ভালোবাসার মিঠাস মুছে গেছে সেই কবেই অত্যাচারের গভীর ক্ষততে। প্রথম দিকটা ছেলের সাথে দেখা করতে আসত মাঝেমধ্যে। তারপর আর আসেনি,কারণ ততদিনে নতুন সংসার ফেঁদেছে লোকটা। এমন লোকের আবার বিয়েও হয়,সত্যিই পুরুষ মানুষ বড় দামি এই পৃথিবীতে!
মা ছেলের সংসারে মান অভিমান,ঝগড়া,শাসনের মাঝে ভালোবাসা আর কর্তব্যের টানাপোড়েনের মাঝে হঠাৎই অনুর জীবনে এলো এক দখিনা বাতাস। বুঝতেই পারেনি প্রথমে একটু কথা আর সহানুভূতির বাতাস কখন দখিনা বাতাস হয়ে মন জুড়োবে তার শ্রান্ত,ক্লান্ত জীবনে।
সেদিন অনেক রাতে মেসেজ এসেছিল দিল্লী থেকে আসছেন ওদের সুপারভাইজার আর তাকে রিসিভ করতে অনুকেই যেতে হবে এয়ারপোর্টে কারণ যার যাওয়ার কথা ছিল সে হঠাৎই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়াতে যেতে পারছে না। তাই রাজকে একটা ছোট নোট লিখে সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল অনু। আর সত্যিই সেদিন ছেলের জন্য কোন কিছুই রেখে যেতে পারেনি তাড়াহুড়োয়। একটু খারাপ লাগলেও পরে ভেবেছে শিখুক নিজেরটা নিজে করে নিতে। অনেক বড় হয়ে গেছে এখন,একটা চাকরিও করছে সুতরাং এবার নিজেকে সামলাতে শেখা জরুরী। আর নিজেকে সামলাতে তো শিখেছে বেশ,এখন কত বন্ধু,বান্ধবী হয়েছে। তাদের সাথে ঘুরছে,বেড়াচ্ছে,পার্টি করছে। কখনও সেই পার্টি থেকে ফিরতে রাতও হয়ে যায়। এই নিয়ে অশান্তিও হয়েছে কয়েকবার অনুর সাথে। ছেলের মুখের থেকে সেই গন্ধটা পেয়ে প্রথমদিন খুব চিৎকার করেছিল অনু..' আর কী রক্ত তো কথা বলবেই? যেই নিজের হাতে টাকা পেয়েছিস ব্যাস শুরু হয়ে গেছে তাই তো..আর কী এবার থেকে প্রতিদিন এগুলো খেয়ে আয়। হে ভগবান কার জন্য আমি এতদিন এত কষ্ট করলাম?'
মেজাজ হারিয়েছিল রাজও,' মা প্রতিদিন এত ঝামেলা আর ভালো লাগে না। তুমি কথায় কথায় বাবার সাথে আমার তুলনা কর কেন বলত? আমি কী মাতাল? আজ সুফিয়ার বার্থডে ছিল তাই সবাই একটু আনন্দ করল। মা ঐ ব্যাকডেটেড মেন্টালিটি এবার ছাড়ো। একটু আধটু ড্রিংক অকেশনালি এখন সব ছেলেমেয়েরা করে। এত রিজিড হলে তো মুশকিল।'
রাতের মত অশান্তি থেমেছিল,সরি বলেছিল রাজ। কিন্তু বন্ধুবান্ধব আর পার্টি ছিল আগের মতই। একটু সংযম দেখিয়েছিল ছেলে। আর অনু নিজেকে শান্ত করেছিল ওর বন্ধুরা বুঝিয়েছিল ছেলে বড় হয়েছে। এত খিচখিচ করলে আরও বিগড়ে যাবে।
আজকাল মনে মনে অনেক একা হয়ে গেছিল অনু। মাঝেমধ্যেই মনে অনেক কথা জমছিল। একা একা কতই না চোখের জল ফেলত। আর কিছুটা দূরত্ব বাড়ছিল মা আর ছেলের। আগের মত আর মা ছেলের আদুরে গল্পগুলো কমছিল,ছেলে কাজ থেকে ফিরে এসে ব্যস্ত হত ফোনে। বাইরের মানুষের সাথে সময় কাটিয়ে তেমনভাবে সময়ই পেত না মায়ের মনের খবর নেবার। ঐ খাওয়ার টেবিলে অল্প কিছু কথা। অনু ভাবে ভাগ্যিস একটা চাকরি করত কে জানে নাহলে কী করে সময় কাটাতো?
Comments
Post a Comment