জীবনের কোন সময় আপনি কেমনভাবে উপভোগ করছেন সেটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় কথা। বাড়ির ডেক্সটপ কেনার পর ছেলের উদ্যোগে প্রথমে অরকুট আর তারপর ফেসবুকে এলেও আমার কাছে মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল ক্যামেরা কোন কিছু না থাকাতে ফটো তেমন দেওয়া হত না। তাছাড়া তখন সময় কোথায়? দুই ছেলেমেয়ে,চাকরি,সংসার নিয়ে দারুণ ব্যস্ততা চলছে। হয়ত বা সারাদিনে ঐ একবার স্কুল যাবার সময় আয়নাতে মুখ দেখে যেতাম। খাবার দাবার কোন কিছুতেই বাছাবাছি ছিল না। সব কাজ সেরে বাড়িতে যা রান্না হত খিদের পেটে তাই গপাগপ গিলতাম। বাচ্চা হবার আগে বা পরের যাত্রাপথ তো ছিল আরও শোচনীয়। আমার শাশুড়িমা ছিলেন না,সুতরাং বাচ্চা হবার আগের যত্ন করার মত তেমন কেউ ছিল না। মা দূরে থাকতেন তাছাড়া তিনিও চাকরিরতা। আমরা মা,মেয়ে দুজনেই যেহেতু চাকরি করতাম তাই কারোরই একটানা কারও কাছে এসে থাকা সম্ভব ছিল না। ছেলের সময় যখন নার্সিং হোমে ভর্তি হতে গেলাম আমার মনে আছে আমি রাত্রি প্রায় নটা নাগাদ বাড়ি থেকে না খেয়ে ভর্তি হলাম সেখানে। নার্সিংহোমে তখন খাবার প্রায় শেষ,তবুও পরের দিন আমার সিজার হবে তাই খাওয়া হবে না জেনে ওরা একটু ঠান্ডা ডাল ভাত এনে দেয় এবং কথাও শুনতে হয় তার জন্য। মা অনুরোধ করেও আমাদের সবসময়ের লোককে দিয়ে ভাত বসাতে পারেনি সেদিন। আর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি সুতরাং সেখানে মাতব্বরি করার মত ক্ষমতা তখনও তার হয়নি। যদিও কিছু বছর পর দিন পাল্টেছিল। আমি সেই থেকে শিখেছিলাম সংসারে লড়তে হলে পেটে খাবার দিতে হবে। শরীরে জোর না থাকলে খাটতে পারব না। আর না খাটলে কে আমাকে ছাড়বে? বিশেষতঃ আমার ছেলেমেয়েদের কে দেখবে? তারপর থেকে খিদের মুখে যা পেয়েছি,খেয়েছি। ওজন বেড়েছে নিজের তালে,আমিও ছুটেছি। শরীরে কোন সমস্যা ছিল না তেমন তাই পরোয়া করিনি। তখন শুধু একটাই চিন্তা যাদের এনেছি এই পৃথিবীতে তাদের বড় করতে হবে। সাজগোজ,ফিগার কিছু নিয়েই মাথাব্যথা ছিল না। তাতে অবশ্য স্বামীর ভালোবাসাতেও কোন ঘাটতি হয়নি। সেও কোনদিন বলেনি তুমি কেন মোটা?ঘুরতে বেড়াতে গেছি। সেখানেও পরনে শাড়ি আর ট্যাঁকে দুই ছানা। একজন কোলে আরেকজন পাশে। কম বয়েসের মাতৃত্বের তৃপ্তিতেই সেই ছবি সুন্দর। ঘাম চুইয়ে পড়া গালে লালিত্যের ছাপ,বড় সিঁদুরের টিপ পরা মুখে স্বামী সোহাগের পরিতৃপ্তি। বেড়াতে যাওয়ার ছবিগুলো নিয়ে যেদিন অফিস ফেরত কর্তার আসার কথা সেদিন অপেক্ষা করে বসে থাকতাম। তারপর দুজনে মাটিতে বসে ফটো ছড়িয়ে দেখতাম একটা একটা করে। সব ফটো উঠত অ্যালবামে,মনেই হত না কোনটাতে আমায় মোটা লাগছে বা কালো লাগছে। বাড়িতে কেউ এলে খুলে বসা হত অ্যালবাম আর তার সাথে গল্প কথা।
যুগ এগিয়েছে,সাদামাটা কানে ছোট দুল পরা আমি সাজতে শিখেছি একটু অবসর পেয়ে। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ইএমআই দিয়ে নিজের কেনা ফ্ল্যাটে উঠেছি। একটু স্বচ্ছ্বল আর ঝাড়াঝাপটা হয়ে শৌখিন হয়েছি তখন। কোন কোন বন্ধু বলেছে,'তুই এখন খুব সাজিস আগে একদম সাজতিস না। আমিও হেসে বলেছি,' আরে সময়ই পেতাম না নিজেকে দেখবো। তাছাড়া টাকাপয়সাও ছিল না হাতে।'
যে কথা বলব বলে এত কিছু লিখলাম সেটা এবার বলি,মাতৃত্ব এমন একটা পর্যায় যেখানে মেয়েদের শরীরের ওপর দিয়ে যে কী যায় তা হয়ত অনেকেই বুঝতে পারেন না। ওজন বেড়ে যায়,হরমোনের পরিবর্তন হয়,পেট হয় অনেকের ক্ষেত্রে ফুটিফাটা যেমন আমার হয়েছিল। জামাকাপড় ছোট হয়,নিতম্ব ও বুকের গড়নেও আসে আমূল পরিবর্তন। আমি রাতে পাশ পর্যন্ত ফিরতে পারতাম না আট মাসের পর। উঠে বসে তারপর অন্য পাশে শুতাম। বাচ্চা হবার পর শুরু হয় আরেক সংগ্ৰাম,রাত জাগা চলে দিনের পর দিন। খাওয়া দাওয়ার ঠিক ঠিকানা থাকে না। এসব নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামাইনি,পাখির নজর ছিল শুধু বাচ্চার দিকে। ওদের বুকে জড়িয়ে পেয়েছি অপার শান্তি। আমাদের সময় নেট দুনিয়া ছিল না। নিজেদের ভালোলাগার দুনিয়াতেই আমরা বেঁচেছি আমাদের মত করে। ইন্টারনেটে ছবি দেখে কেউ আমাদের বডি শেমিং বা ট্রোলিং করেনি। অবশ্য আমরা কোন সেলিব্রেটি ছিলাম না। কয়েকদিন ধরে দেখছি বিপাশা বসুকে নিয়ে ট্রোলিংয়ের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কোন প্রসাধন ছাড়া বাইরে হয়ত প্রয়োজনেই বেরিয়ে ছিলেন বিপাশা সেখানে তাকে ক্যামেরাবন্দি করে ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয় নেটবাজারে। ব্যাস শুরু হয়ে নেটিজেনদের কমেন্টীয় অ্যাটাক... বিপাশা বসু বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে গেছে,তাকে চেনা যায় না। সে বোধহয় শুধু খাচ্ছে,ঘুমোচ্ছে। বুড়ি হয়ে গেছে বলে আর কিছুই করছে না। নেট দুনিয়ার দৌলতে এই ট্রোলিং কথাটা খুবই পরিচিত,এখানে কেউ কাউকে ছাড়ে না বরং নিজের ঘরের খেয়ে এই ট্রোলাররা বনের মোষ তাড়াতে ভালোবাসে। মোষ তাড়াতে গিয়ে কখনও লাথিও খায় কিন্তু তাতেও শিক্ষা হয় না।
বিপাশা বসু মোটা হয়েছে বাচ্চা হবার পর তো বেশ হয়েছে। ঐশ্বরিয়া রায়ের ডাবল চিন হয়েছে তো বেশ হয়েছে, অমুকে বুড়ি হয়ে লাল শাড়ি পরেছে তো বেশ করেছে,অমুকে বুড়ো বয়েসে বিয়ে করেছে তো বেশ করেছে। তোমাদের কি হে? ওরা তোমাদের খায় না পরে? নাকি তোমাদের কাছে কোন বিউটি টিপস চাইতে এসেছে? ওরা চাইলে শুধু কেন আমাদের মত সাধারণ মানুষও চাইলে নিজেদের ওজন কমাতে পারি। কেন কমাচ্ছে না? কেন নিজেকে মেইনটেইন করছে না এটা ওদের ব্যাপার। মাতৃত্বের পরিবর্তন একেক শরীরে একেকভাবে আসে সেটা যারা মেনে নিয়ে ভালো আছে তারা সত্যিই ভালো আছে। জীবনে কোন চাপ নেব না,সন্তান নেব না,কোন দায়িত্ব নেব না। এটা যদি সত্যিই জীবন হত তবে জীবনচক্র থেমে যেত। সুতরাং প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার কী দরকার?আর কে মোটা হল? কে বুড়ি হল? কার চামড়া ঝুললো না দেখে বরং নিজের দিকে তাকান,নিজের পরিবারের দিকে তাকান। নিজের মা তার মাতৃত্বের পর কতটা পরিবর্তিত হয়েছেন সেগুলো ভাবুন। অনেক ভালো থাকবেন। কাউকে খারাপ বললে,নিজেকেই ছোট করা হয়। একেকজনের শরীর একেক রকম,হয়ত বিপাশা এখন বাচ্চা মানুষ আর সংসারটাই করছেন মন দিয়ে। ঐশ্বরিয়া তার মেয়েকে নিয়েই খুশি আছেন। থাকতে দিন তাদেরকে তাদের মত। নেট দুনিয়ায় সবাই সবাইকে দেখতে পাই বা টুক্ করে অন্যের অন্দরে ঢুকতে পারি বলে অযথা অন্যের ভালো বা মন্দ নিয়ে বেশি ভেবে নিজের মাথা খারাপ করবেন না। নিজে ভালো থাকুন এবং অন্যদেরও ভালো থাকতে দিন অনেক তো হল ট্রোলিং,বডি শেমিং এবার থামুন। মনটা আনচান করছে? নিজের মুখটা বারবারই আয়নায় দেখুন,কিরিম টিরিম মাখুন যাতে আপনি কোনদিন না বুড়ি হন। যোগা আর জিম করুন শরীর মন ভালো থাকবে,আর যে তেল বাড়তি হয়ে অন্যের চরকায় যাচ্ছে সেটা ঝরে যাবে।
Comments
Post a Comment