বর্ষায় মন উড়ু উড়ু তাই উঠল বাই চলো করি ঘুরু ঘুরু। কিন্তু কোথায় যাই? হাতে মাত্র একটা পুরো দিন,নো থাকাথাকি। ভাবি চলো ভাবি,এই ভাবতে ভাবতেই ঠিক হল বেশি দূরে নয় যাব কাছাকাছি।
দূরে গেলে যাতায়াতেই কেটে যায় অনেকটা সময়,সুতরাং সংক্ষিপ্ত হয় থাকার সময়টা।
পুর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি শিল্পগ্ৰামের কথা ফেসবুকে পড়েছি। তাই ঠিক হল সেখানেই যাবো,কারণ কলকাতা থেকে মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে।
আমরা গাড়ি করে গেছিলাম,আপনারা চাইলে ট্রেনে করে উলুবেড়িয়া স্টেশনে নেমে সেখান থেকে টোটো বা বাসে করে মোহিনী মোড়,তারপর মোহিনী মোড় থেকে ধান্ধালিয়া পুর্ণেন্দু পত্রী শিল্পগ্ৰামে পৌঁছে যেতে পারেন।
ভগবানের কাছে হাত পেতে মন খুলে চাইলাম হে ভগবান বৃষ্টি দিও,আহা মরসুমের প্রথম বর্ষা সুখ মাখতে মাখতে যাবো। ভগবান ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন,সক্বাল সক্কাল বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি মাথায় করেই,মনে খুশি নিয়ে বেরোলাম সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ। গাড়ি চললো এগিয়ে,আমরা দলে পাঁচ। আমাদের আগেরদিন পর্যন্ত প্ল্যান ছিল আমরা পটচিত্র গ্ৰামে যাবো,কিন্তু হঠাৎই ওদিকে বন্যা থাকতে পারে ভেবে মত ঘুরেছে রাতে।
তাই সকালেই পুর্ণেন্দু স্মৃতি শিল্পগ্ৰামে ফোন করলাম আমরা আসছি বলে,এবং আবদার রাখলাম আমরা সেখানে লাঞ্চ করব।
যার সাথে ফোনে কথা হল তার নাম অনুরাধা ম্যাডাম,ভীষণ ভালো ব্যবহার। শুনে বললেন ওখানে যাবার দুদিন আগে জানালে ওনারা খাবার ব্যবস্থা করতে পারেন ভালো করে। তবে আমরা আর্জি রেখেছি সেক্ষেত্রে উনি কথা বলে জানাচ্ছেন পাঁচ মিনিট।
অপেক্ষার পাঁচ মিনিট কাটলো,বললেন হবে ব্যবস্থা তবে আমরা ফেসবুকে যা যা দেখেছি অত কিছু হবে না। এমনি সাদামাটা মেনু হবে,মাছ ভাত। আমরা এক বাক্যে রাজি চলবে মানে দৌড়বে।
জায়গাটা উলুবেড়িয়া থেকে কাছে। আমরা বৃষ্টি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম চট করে উলুবেড়িয়া, কিন্তু তক্ষুনি সেখানে যেতে মন চাইল না কারণ আমাদের লাঞ্চ করার কথা ওখানে। তাই ভাবলাম সকালে ব্রেকফাস্ট হয়নি সুতরাং আরেকটু এগিয়ে কোলাঘাটে গিয়ে বরং ব্রেকফাস্ট করি। বৃষ্টিতে হাইওয়েতে লঙ ড্রাইভ কিন্তু দুর্দান্ত লাগছিল। তার সাথে বাজছিল বর্ষার গান। আর আমাদের গল্পগুজব আর হাসিঠাট্টা তো ছিলই।
কোলাঘাটে বাঁদিকেই ঘোষ রেস্টুরেন্টে গাড়ি থামালেন আমাদের সারথী। দেখলাম বেশ ভীড়,যাইহোক ওরা আমাদের এসি ঘরে এনে বসালো। সবাই ধোসা খেতে চাইল সুতরাং ধোসাই অর্ডার দেওয়া হল। তবে ধোসার স্বাদ আশানুরূপ লাগলো না সুতরাং দিল মাঙ্গে মোর,ধোসা খেয়ে মন না ভরিলো।
অর্ডার দেওয়া হল আলু পরটার তবে শেয়ার করে খাবো এটাই ঠিক হল শুধু স্বাদ বদলের জন্য,সাথে টক দই। আলু পরটা কিছুক্ষণ বাদে এলো,পরটা কম কুলচা বেশি। বাইরেটা তেল বিহীন তবে খেতে ভালো।
এবার রসনা আর বাসনা দুটোই মোটামুটি ফুল ফিলড্ সুতরাং একটু হাল্কা হয়ে আবার উঠে বসা গাড়িতে। তখন বৃষ্টি কমেছে,বেশ রোদ উঠেছে। গাড়ি আবার চললো উল্টো মুখে গড়গড়িয়ে।
গুগলমশাই অন করলাম না কারণ উলুবেড়িয়া মোটামুটি আমাদের তাপসদার ভালো চেনা তাই আটান্ন গেটের কাছ পর্যন্ত গিয়ে খোলা যাবে এটাই ঠিক হল।
উলুবেড়িয়া শহরের ভেতর বেশ ঘিঞ্জি,গাড়ি চলা দায়। যাক কিছুটা সময় এভাবে চলার পর আবার ফাঁকা রাস্তায় এলাম,আকাশ তখন মেঘলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা আটান্ন গেটের কাছে এলাম,ভরা রূপনারায়ণের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। জল থৈ থৈ ভরা বুকে,মাখছে বরষা মনের সুখে।
গুগল ম্যাপ অন করলাম তবে যেদিক দিয়ে যেতে বলছে সেদিকে এসে মনে হল ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। অগত্যা অনুরাধা ম্যাডামকে ফোন করা হল,উনিই স্থানীয় একজনকে বুঝিয়ে বললেন যে আমাদের মোহিনী মোড়ে যেতে হবে। সেখান দিয়েই পৌঁছনো যাবে আমাদের গন্তব্যে। সুতরাং পেছন পানে ফেরত এলাম,বুঝলাম সবসময় যন্তর ঠিক কম্ম করে না,তখন মানুষকেই কাজে লাগে। একটাই পাওনা হল যে আটান্ন গেট দেখলাম।
মোহিনী মোড়ের কাছে আসতেই চট করে পাওয়া গেল আমাদের গন্তব্যের খোঁজ। বাঁদিকের পথ দিয়ে ঢুকে কিছুটা যাবার পরই ডানদিকের গেট পেরিয়ে গ্ৰামের পথ দিয়ে পৌঁছে গেলাম পুর্ণেন্দু পত্রী শিল্পগ্ৰামে। আবার বৃষ্টি শুরু হল,আমাদের মনোবাসনা একদম পূর্ণ। লোহার গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম, নামে গ্ৰাম থাকলেও এটা আসলে একটা পাঁচবিঘার ওপর বিরাট জায়গা নিয়ে একটা বাড়ি যার মধ্যে আঁকার স্কুল,আর্ট গ্যালারি,থাকার জায়গা,বাগান,ফল ফুলের গাছ এবং পুকুর নিয়ে বেশ একটা মিনিয়েচার মিষ্টি ছোট্ট গ্ৰামের রূপ নিয়েছে।
আমাদের ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল শিল্পী শ্রী রঞ্জিত রাউত মশায়ের সঙ্গে যাঁর উদ্যোগেই হয়েছে এই শিল্পগ্ৰাম,আর্টগ্যালারি,লাইব্রেরী,বাচ্চাদের শেখার জায়গা এমনকি বিপণন কেন্দ্রও।
চারদিকে সুচারু রুচি আর শিল্পের ছোঁয়া আর তার সাথে প্রকৃতির মাঝে সুন্দর সুন্দর বসার জায়গা এবং ফুল আর ফলের গাছ। মন ছুঁয়ে গেল লেখাগুলো দেখে। ঢুকতেই ডানদিকে দেখলাম পুর্ণেন্দু পত্রীর মূর্তি তিনি মগ্ন লেখাতে।
সবুজের ছোঁয়া আর বৃষ্টির ঝিরঝিরে জলের ফোঁটায় মনকে তৃপ্ত করে হাজির হলাম ডাইনিং প্লেসে। সুন্দর লেবুপাতা কুচি লেওয়া লেবু চিনির সরবত দিয়ে আমাদের ওয়েলকাম জানানো হল।
ঘর পেতে একটু দেরি হবে সুতরাং আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম চারপাশে। প্রথমেই এলাম পুকুরঘাটে। সুন্দর করে বাঁধানো ঘাট আর বেশ বড় পুকুর। পুকুরের ওপারে অনেক হাঁস তবে বৃষ্টির জন্য সেদিকে যাওয়া হল না। পুকুরে প্রচুর মাছ আছে বুঝলাম, তারা নিশ্চিন্তে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। শুনলাম ইচ্ছেখেয়ালে মাছ ধরা হয় কোন নিয়ম করে নয়। পুকুরঘাটের ওপর আঙুর পাতার ছাউনি,এখানে আঙুর হয়েছে দেখে অবাক হলাম। দেখলাম থোকা থোকা আঙুর হয়েছে।
রান্নাঘরে টুলুদি তখন হাসিমুখে রান্নার হাল ধরেছে, মশলা বাটছে পাটায় বসে। সবই শিলনোড়ায় বেটে খাওয়াবে বললো। তবে একটু দেরি হবে কারণ আমরা আজই খবর দিয়েছি।
আমাদের অবশ্য কোন তাড়া নেই,পেটে গিজগিজ করছে উত্তর ভারত আর দক্ষিণ ভারতের খাদ্যাখাদ্য একসাথে।
আমরা বাগানে ঘুরতে বেরোলাম,দেখলাম গাছ ভর্তি সবেদা,আম,কামরাঙা,আমড়া। জাম আর জামরুল পাড়া হয়ে গেছে। আমও পাড়ছে আমাদের সামনেই,এগুলো আম্রপালি তাই একটু দেরিতে পাড়ছে।
হাঁস আর রাজহাঁস দেখেছি কিন্তু এখানে যে একটা আস্ত টার্কি আছে তা ভাবতে পারিনি। মেয়ের ডাকাডাকি শুনে গিয়ে দেখি খাঁচাবন্দি টার্কি ঘোরাঘুরি করছে,ওর একটা সঙ্গী থাকলে ভালো হত।
ততক্ষণে আবার বৃষ্টি নেমেছে,আমাদের মনও উতলা হল। একটু ভিজলামও বৃষ্টিতে। ততক্ষণে আমাদের ঘর রেডি হয়ে গেছে। আমাদের ঘর দোতলায়,এখানে থাকার ঘর সবই দোতলায়। শুনলাম মোটামুটি পঁচিশ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে।
সব জায়গাতেই রুচির পরিচয় আছে,ঘরের নাম স্ত্রীর পত্র। দরজায় একটা ছোট্ট ঘন্টি ঝুলছে কলিং বেলের বিকল্প হিসেবে।
ঘরে চারটে বেড পাতা,এসি ঘর। আমরা ডে ট্রিপে গেছিলাম ঘরের ভাড়া পড়েছিল হাজার টাকা। এখানে জনপ্রতি সারাদিনের খাওয়া খরচ সাড়ে নশো টাকা। আমরা শুধু দুপুরের খাওয়া খেয়েছিলাম,এবং সব পদ করে দেওয়া যাবে না তাই আমাদের দিতে হয়েছিল চারশো করে জনপ্রতি। কী খেয়েছি? হ্যাঁ বলছি একটু বাদেই।
বাইরে তখন বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগছে। পুকুরের জলে কাঁপন ধরেছে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে। হাঁসগুলো চুপচাপ হয়ে গেছে। ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে আমরা বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে উপভোগ করছি তখন।
বৃষ্টি থামতেই নীচে নামলাম,নীচে বেশ সুন্দর একটা মঞ্চ মত আছে। মেয়ের ইচ্ছে একটু নাচবে সুতরাং আমরা সবাই যোগ দিলাম নিজেদের মত করে আনন্দে। এত সুন্দর পরিবেশে মন ভালো হয়ে গেল। আবার চারপাশে একটু ঘোরাঘুরি করলাম,কী সুন্দর সাজানো চারপাশটা। সামনে পদ্মফুলের গাছও লাগানো হয়েছে।
অনেকটা সময় বাদে দুপুরের খাবার ডাক পড়ল। তবে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে চমকে গেলাম। সুন্দর মাটির থালায় ভাত বাড়া হয়েছে। পাশে কত কিছু দিয়ে সাজানো। একটা বড় ঝুড়ির মত ট্রেতে থরে থরে বাটি সাজানো। শুনেছিলাম আজ আমরা জানিয়েছি তাই অল্প কিছু করে দেবেন আমাদের। কিন্তু পরিবেশন দেখে মন ভালো হয়ে গেল। এমনকি মেয়ের জন্য একটু চিকেন চেয়েছিলাম,সেটাও হবে না বলেও হয়েছে। টেবিলে মাটির গ্লাসে জল ভরে আমরা বসে পড়লাম খেতে। বিনোদ আর টুলু ঐ গ্ৰামেই থাকে। ওরা সম্পর্কে ভাইবোন। দুজনে মিলে খুবই যত্নে এবং হাসিমুখে আমাদের খেতে দিল।
এবার মেনু বলি...ভাত,উচ্ছে আলু পোড়া মাখা,মানকচু বাটা, পটল চিংড়ি বাটা,লাউশাক বাটা,সজনে ডাঁটা, কুমড়ো,পটল,আলু, ঝিঙের পাঁচমিশালী সব্জি,মুগ ডাল,মাছের কালিয়া,চিকেন কষা,মিষ্টি আর গাছের আম্রপালি আম। যেটা তখনি পাড়া হয়েছে। সাথে শেষ পাতে রসগোল্লাও ছিল।
এত কিছু খেয়ে তো আর সাথে সাথে বেরোনো যায় না,কিছুটা সময় পুকুর পাড়ে কাটিয়ে মাছেদের খেলা দেখে ফিরলাম ঘরে। একটু গড়িয়ে নিলাম সবাই।
এখানে আর্ট গ্যালারি আছে, যা দেখার জন্য পঞ্চাশ টাকা জনপ্রতি দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। বিনোদকে বলা ছিল। বিকেলে ও খুলে দিল আর্ট গ্যালারি, এখানে অনেক ছবি আছে তারমধ্যে বেশিরভাগ রঞ্জিত বাবুর আঁকা,কিছু তাঁর কন্যার এবং ছাত্রদের আঁকা। আর আছে পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা ছবি আর বই। বেশ কিছু মাটির এবং কাঠের মূর্তিও আছে। দোতলা গ্যালারি দেখে মন ভরে গেল।
সবশেষে এলাম বিপণন কেন্দ্রে ওখানে টুকটাক কিছু কিনে এবার ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। বেলা পড়েছে তখন,ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। গাড়িতে আসতে আসতে দেখলাম সবুজের নানা বাহার,একটা বৃষ্টিভেজা দিনে সবুজে চোখ ডুবিয়ে আর শিল্পগ্ৰামে সারাদিন কাটিয়ে বেশ লাগলো। এই গ্ৰামের উদ্বোধন করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়।
Comments
Post a Comment